সদলবলে রাশিয়া ছাড়ছেন রাশিয়ানরাই! বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম। একমুখী বিমানের টিকিট বিক্রিতে নতুন রেকর্ড গড়ল রাশিয়া। ২১ সেপ্টেম্বর মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল বিদেশযাত্রার ফ্লাইটের সমস্ত টিকিট। তাও স্বাভাবিকের থেকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি দাম দিয়ে সেই টিকিট কিনলেন হাজার হাজার মানুষ। কারোর গন্তব্য আজারবাইজার, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান। কেউ আবার চলেছেন তুরস্ক, জর্জিয়া কিংবা আর্মেনিয়ায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, বিদেশের যাত্রার হাজার হাজার টিকিট বিক্রি হলেও, দেশে ফেরার টিকিট বিক্রির হার বদলাল না এতটুকু। 

গ্লোবাল ফ্লাইট ট্র্যাকিং সংস্থা ‘ফ্লাইট-রাডার২৪’-এর হাত ধরে সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে এই তথ্য। তাছাড়া গুগল ট্রেন্ডস এবং রাশিয়ার (Russia) সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাভিয়েশন ওয়েবসাইট ‘অ্যাভিয়াসেলস’-এর রিপোর্টও বলছে একই কথা। না, পর্যটন কিংবা ব্যবসায়িক সূত্রেও নয়, একমুখী টিকিটের এই বিক্রি স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে দেশ ছাড়ছেন (Leaving) হাজার হাজার রাশিয়ান মানুষ। কিন্তু রাতারাতি কেন হিড়িক পড়ল দেশ ছাড়ার?

গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল রাশিয়া এবং ইউক্রেনের। অবশ্য যুদ্ধ না বলে, এই সংঘাতকে ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন’ বলেই চিহ্নিত করেছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। তারপর পেরিয়ে গেছে ৭ মাস। কিন্তু এতটুকু বদলায়নি পরিস্থিতি। যুদ্ধবিরতির নামগন্ধ নেই এখনও। একদিকে যেমন রাশিয়ার সঙ্গে সামনাসামনি বৈঠক করার কথা সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি, অন্যদিকে আক্রমণ আরও তীব্রতর করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ক্রেমলিন। এমনকি সম্প্রতি পুতিন জানিয়েছেন, পরিস্থিতি যে-কোনো মুহূর্তে পরমাণু যুদ্ধের রূপ নিতে পারে।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই গতকাল আরও একটি বড়ো ঘোষণা করেন পুতিন। আংশিক সামরিক সমাবেশ বা পার্সিয়াল মিলিটারি মোবিলাইজেশন (Partial Military Operation)। বিষয়টা ঠিক কী? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দুক হাতে যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিলেন কোটি কোটি সাধারণ মানুষ। কেউ ছিলেন শিক্ষার্থী, কেউ আবার সাধারণ ব্যবসায়ী কিংবা কৃষক। শুধু সোভিয়েতই নয়, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি— সর্বত্রই দেখা গিয়েছিল এই ঘটনা। সাধারণ মানুষকে যুদ্ধক্ষেত্রে নামানোর এই বিষয়টিকেই সামরিক পরিভাষায় বলা হয় মোবিলাইজেশন। 

আরও পড়ুন
নরমাংসের স্বাদ কেমন? জানাচ্ছেন রাশিয়ার ‘মানুষখেকো’

স্তালিনের সময় থেকেই সোভিয়েতের রুল-বুকে উল্লেখ রয়েছে মোবিলাইজেশনের কথা। জরুরি অবস্থায় দেশকে সামরিক পরিষেবা প্রদান করা সাংবিধানিকভাবে সেখানকার নাগরিকদের মৌলিক কর্তব্য। তবে বিশ্বযুদ্ধের পর এই পথে এই প্রথম হাঁটতে চলেছে রুশ। 

আরও পড়ুন
রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদ, গ্রেপ্তার রুশ বৃদ্ধা

পুতিনের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী, রুশ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য ডাক পাঠানো হবে ১৬-৬৫ বছর বয়সি ৩ লক্ষ সাধারণ মানুষকে। পরবর্তীতে আরও বাড়ানো হতে পারে এই সংখ্যা। কিন্তু হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত কেন? পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউক্রেন আক্রমণের জন্য ১ লক্ষ ৯০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিলেন পুতিনি। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত ৫ হাজার সেনা প্রাণ হারালেও, আন্তর্জাতিক রিপোর্ট বলছে যুদ্ধে মারা গেছেন ৫৫ হাজার রুশি। সেই শূন্যস্থান ভরতেই মরিয়া রুশ-প্রেসিডেন্ট। তবে আপদকালীন সময়ে নিয়োগ করতে চলা সেনানীদের যে একেবারেই সামরিক প্রশিক্ষণ নেই, তেমনটা নয়। রাশিয়ায় ১৮ বছর পেরলেই প্রায় বাধ্যতামূলকভাবেই অধিকাংশ মানুষকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। বিশেষত পুরুষদের। ট্রেনিং-প্রাপ্ত এইসকল মানুষকেই সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে। 

আরও পড়ুন
ইউক্রেনে ফসফরাস বোমা নিক্ষেপ রাশিয়ার, কেন নিষিদ্ধ এই বোমা?

পুতিনের এই ঘোষণার পরেই দেশ ছাড়ছেন হাজার হাজার মানুষ, এমনটাই অনুমান যুদ্ধ-বিশ্লেষকদের। অন্তত পরিসংখ্যান বলছে তেমনটাই। স্বাভাবিক জীবনযাপন ছেড়ে যুদ্ধের ময়দানে নামতে নারাজ অধিকাংশ মানুষই। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের কারণে রাশিয়ান অর্থ রুবেলের মূল্যও এখন তলানিতে। অর্থাৎ, শিয়রে অর্থনৈতিক সংকট। তাই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। 

‘অ্যাভিয়াসেলস’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত বিদেশযাত্রার টিকিট কাটার ব্যাপারে ১৮-৬৫ বছর বয়সি ব্যক্তিদের ওপর কোনোরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি রাশিয়া প্রশাসন। তবে সে সম্ভাবনাও প্রকট হচ্ছে ক্রমশ। কারণ, সাংবিধানিক মৌলিক কর্তব্য অগ্রাহ্য করা একপ্রকার আইনি অপরাধ সে-দেশে। ফলে, দেশত্যাগের এই হিড়িক দেখেও চুপ করে বসে থাকবেন পুতিন, তা প্রায় অসম্ভব। সে যাই হোক না কেন, রাশিয়ার এই ঘোষণা পর বিশ্বজুড়ে আরও খানিকটা বৃদ্ধি পেতে চলেছে উদ্বাস্তু সমস্যা, তাতে সন্দেহ নেই কোনো… 

Powered by Froala Editor