স্থানীয় সময় তখন সকাল ৯টা। ইয়াঙ্গুনের ট্যামিন বাজারে হাজির হয়েছিলেন তাঁরা। সেদিন সন্তানের প্রথম জন্মদিন। এক বছর বয়স হচ্ছে তার। অস্থির পরিস্থিতিতেও তাই সামান্য কিছু উপহার কিনে দিতেই হয়তো বেরিয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। বেশ খানিকটা দূরে চলছে প্রতিবাদ, মিছিল, অবস্থান। কোল থেকে এক বছরের ছোট্ট মেয়েকে নামিয়ে তার হাতে দিয়েছিলেন খেলনা। কিন্তু কে আর জানত মায়ের কোল থেকে নামাই শমন হয়ে উঠবে তার?
নৃশংস বললেও হয়তো কম বলা হয়। বিগত কয়েকদিন ধরেই প্রতিনিয়ত গণহত্যা চলছে মায়ানমারজুড়ে। তবে চরমতম বর্বরতার উদাহরণ দেখা গেল গত ২৭ মার্চ। এক বছরের ছোট্ট শিশুকন্যাকে ক্লোজ রেঞ্জ থেকে রবার বুলেটে বিদ্ধ করল মায়ানমারের সেনা। না, প্রাণ যায়নি। তবে জন্মদিনেই চিরকালের মতো দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে তার একটি চোখ।
গত ২৭ তারিখে ইয়াঙ্গুনের ট্যামিন বাজারে তখনও শান্ত পরিবেশ। সন্তানকে খেলায় মজে থাকতে দেখে প্রতিবেশীর সঙ্গে দু-একটি কথা আদানপ্রদান করছিলেন বার্মিজ দম্পতি। তবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চলের পরিস্থিতি। চিৎকার, স্মোক গ্রেনেড আর বহু মানুষের বিশৃঙ্খল দৌড়। এর মধ্যে সন্তানকে বুকে আগলে নিতে পারেননি তাঁরা আর। ধোঁয়ার পরত কাটতেই সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করলেন, গর্জে উঠল পুলিশের বন্দুক। আর তার লক্ষ্য মাত্র কয়েক ফুট দূরে রাস্তায় বসে থাকা তাঁদেরই সন্তান। চোখ থেকে গড়িয়ে নামছে রক্তের ধারা। গেঁথে আছে রবারের বুলেট।
অপারেশন করে বুলেটটি বার করলেও দৃষ্টিশক্তি আর ফিরবে না বলেই জানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। সম্প্রতি একাধিক প্রতিবাদকারীর নির্মম ঘটনাটির ছবি পোস্ট করেন ট্যুইটারে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তিকে আহ্বান জানান এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে।
আরও পড়ুন
গুলিতে নিহত শতাধিক, পার্টিতে মত্ত মায়ানমারের রাষ্ট্রনেতা!
একদিকে যখন ইয়াঙ্গুনে এমন ছবি, ওই একই দিনে দক্ষিণ-পূর্ব মায়ানমারের বু দো উপত্যকায় ঘটে যায় এমনই আরেকটি নৃশংস ঘটনা। কৃষক বাবার সঙ্গেই সেদিন মাঠে গিয়েছিল তিন বছরের একটি শিশু। সীমান্তবর্তী এই অঞ্চল দিয়েই প্রতিদিন মায়ানমার থেকে পালিয় যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। বেছে নিচ্ছেন শরণার্থীর পথ। কিন্তু সেভাবে সেনাবাহিনী কায়েম করেনি ক্ষমতা। নিশ্চিন্তেই কাজ করছিলেন তাই তিনি। কাছেই বসে ছিল সন্তান।
তবে নিয়তিকে কে আটকাতে পারে? বিগত কুড়ি বছরের মধ্যে এই প্রথমবার নিজের দেশেই আঘাত হানল বোমারু বিমান। সন্তানকে বাঁচাতে দৌড়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। তাঁর আর ফেরা হয়নি। বাড়িতে ফিরেছিল ঝলসে যাওয়া নিথর একটা দেহ। সেইসঙ্গে রক্তাক্ত তিন বছরের শিশুটি। প্রাণ বাঁচলেও তার ঘাড়ে, বুকে গিঁথেছে লোহার টুকরো, পেরেক। সেখান থেকে সংক্রমণও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর দেহে। জীবনের সঙ্গে ক্রমাগত পাঞ্জা লড়ে চলেছে সে। আর অন্যদিকে এই শোকাঘাতে পাথর হয়ে গিয়েছেন তার মা। কথাও ফুটছে না মুখ থেকে।
আরও পড়ুন
‘আন্দোলন করলে সোজা মাথায় গুলি’, ঘোষণার পরের দিনই হত্যা ১১৪ জন-কে!
শুধুমাত্র এই দুই ঘটনাতেই শেষ নয়। এছাড়াও সবমিলিয়ে গোটা মায়ানমারে বিগত এক মাসে মারা গেছে অন্ততপক্ষে ৪০টি নাবলক-নাবালিকা। যাঁরা অবস্থানে অংশ নেয়নি কোনোভাবে। রাজনীতির ভাষাও তারা জানে না বিন্দুমাত্র। তাও তাঁদের শিকার হতে হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে। দেশের ভবিষ্যৎকে এভাবে মুছে ফেলাও কি সভ্যতাই শেখাচ্ছে আমাদের? জানা নেই। এই নির্মমতার শেষ কোথাও তারও হদিশ নেই আমাদের কাছে। তবে আশ্বাস এটুকুই, একদিন না একদিন ইতি পড়বে স্বৈরাচারে। আন্দোলনের সামনে মাথা নোয়াবে শাসক…
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বন্ধ ইন্টারনেট পরিষেবা, বিচ্ছিন্ন মায়ানমারের আন্দোলনকারীরা