বছরের শুরুর দিকেই ইয়েস ব্যাঙ্কের সঙ্গীন অবস্থা দেখেছিল গোটা ভারত। ব্যাঙ্কের ক্রমশ ধুঁকতে থাকা পরিস্থিতি সামাল দিতে আসরে নেমেছিল দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। শেষ লগ্নে এসে আবারও একই পরিস্থিতি দেখল ভারত। এবার ইয়েস ব্যাঙ্ক নয়; সংকটের মুখে লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক।
দেখতে দেখতে এই বছরই ৯৪ বছরে পা দিল তামিলনাড়ুর এই ব্যাঙ্কটি। শতবর্ষের মুখে দাঁড়িয়ে হয়তো নানারকম পরিকল্পনাও নিচ্ছিল ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। হাজার হোক, এত লম্বা একটা ইতিহাসের কথা। ১৯২৬ সাল। পরাধীনতার লড়াইয়ে সামিল হয়েছে দেশের প্রতিটি কোণার মানুষ। সেইসঙ্গে জায়গায় জায়গায় তৈরি হচ্ছিল দেশীয় প্রতিষ্ঠান। এমন পরিস্থিতিতে তামিলনাড়ুর কারুর শহরের সাতজন ব্যবসায়ী এক জায়গায় হলেন। এই পুরো আয়োজনের মূল দায়িত্বে থাকলেন ভি এস এন রামলিঙ্গ চেত্তিয়ার। বলে রাখা ভালো, কারুর-কে সেই সময়ই তামিলনাড়ুর ‘টেক্সটাইল সিটি’ বলা হত। চারিদিকে নিজের নিজের ব্যবসা শুরু করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন। পরিস্থিতিও সেরকমটাই ছিল…
কারুরের ওই মানুষগুলোর পাশে আর্থিকভাবে দাঁড়ানোর জন্য একটি দেশীয় ব্যাঙ্কের খুব প্রয়োজন বলে মনে করলেন ভি এস এন রামলিঙ্গ চেত্তিয়ার। তাতে সায় দিলেন বাকিরাও। শেষ পর্যন্ত ১৯২৬ সালের ৩ নভেম্বর যাত্রা শুরু হল লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্কের। কারুর-সহ তামিলনাড়ুর ইতিহাসের সঙ্গেও জুড়ে গেল একটা ব্যাঙ্ক। শুরুর দিকে অনেকটা সময় কেবলমাত্র কারুর শহরে কাজ হলেও, পরের দিকে তামিলনাড়ুর অন্যত্রও ছড়াতে আরম্ভ করে।
স্বাধীনতার দিনটি পেরিয়ে এসেছে ভারত। গোটা দেশকে একসূত্রে বাঁধতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়েছে। দেশের সমস্ত ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকেও তো এক ছাতার তলায় আনতে হবে! আর এই পুরো ব্যবস্থার হাল ধরে রাখার জন্য পথ চলা শুরু হল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার। সেইসূত্রেই ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাসে আরবিআই থেকে বৈধ লাইসেন্সও পেয়ে গেল লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক। ‘কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক’-এর তকমা তো জুটলই; সেইসঙ্গে প্রস্তাব এল ভারতের অন্যান্য জায়গায় নিজের শাখা ছড়িয়ে দেওয়ার। তাহলে ব্যবসাও বাড়বে। এই পুরো কাজটাই শুরু হয় ষাটের দশকে। দক্ষিণ ভারতের আরও নয়টি ব্যাঙ্ককে নিজের সঙ্গে যুক্ত করার পর লক্ষ্মীবিলাস ছড়িয়ে পড়ল অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, কর্ণাটক, মুম্বইয়ের মতো জায়গায়। প্রথমে দক্ষিণ ভারতে সীমাবদ্ধ থাকলেও একটা সময় উত্তরেও চলে আসে এই সংস্থা। এমনকি, কলকাতাতেও এই ব্যাঙ্কের শাখা খোলা হয়। কারুর থেকে ব্যাঙ্কের প্রধান কার্যালয় সরে আসে চেন্নাইতে।
কিন্তু সময় তো সবার একরকম চলে না। একটা সময় বেশ তরতরিয়েই উঠছিল লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্কের গ্রাফ। যত দিন গেছে, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গেও নিজেকে একাত্ম করেছিল এই সংস্থা। গ্রাহকেরাও খুশি। সমস্যাটা শুরু হয় বিগত কয়েক বছর ধরে। গত তিন বছর যাবৎ আর্থিক ছবিটাও ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করে। সমস্ত ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ে, লেনদেনের ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি হয়। ফলে টান পড়ে ব্যাঙ্কের ভাণ্ডারে। এদিকে দেশ জুড়ে ৫০০-রও বেশি শাখা। অসহায় অবস্থার সামনে পড়ে লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক। তার মধ্যে নোটবন্দি, করোনা অতিমারি বিপদকে আরও খানিক বাড়িয়ে দেয়…
২০২০-র শুরুর দিকে ইয়েস ব্যাঙ্কের মোরেটোরিয়ামে চলে যাওয়ার পর আশঙ্কাটা বাড়তে থাকে। আরও আর্থিক ক্ষতি হতে থাকলে গ্রাহকরাও যে বিপদে পড়বেন। এমন পরিস্থিতিতেই তদন্ত শুরু করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সম্প্রতি, ১৬ নভেম্বর থেকে মোরেটোরিয়ামও জারি করল কর্তৃপক্ষ। আপাতত পুরো ব্যাঙ্কই আরবিআইয়ের অধীনে। আগামী এক মাসের জন্য বেশ কিছু নির্দিষ্ট নিয়মও তৈরি করে দিয়েছেন তাঁরা। এর মধ্যে লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ককে যাতে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় তারই চেষ্টা করা হবে। না হলে, আবারও দেশের ইতিহাস থেকে মুছে যাবে আরও একটি ব্যাঙ্ক। ঘটনাচক্রে, আর ছয় বছর পর ব্যাঙ্কটির শতবর্ষ। তার আগেই এই অবস্থা কেউই মেনে নিতে পারছেন না। কারণ, ফলাফল, সম্ভাবনাগুলো নিয়েই আলোচনা চলছে। আর এতকিছুর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ৯৪ বছরের পুরনো লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক।
আরও পড়ুন
আজ থেকে বদলাচ্ছে নিয়ম, এটিএম থেকে টাকা তুলতে নয়া ব্যবস্থা স্টেট ব্যাঙ্কে
Powered by Froala Editor