বিজ্ঞানের জগতে কোনো সীমানা নেই। দেশকালের গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায় না তাকে। আর তাই বিজ্ঞানীরাও গবেষণার স্বার্থে নানা সময়েই এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি দেন। এই বিষয়টি সবচেয়ে গভীরভাবে ধরা পড়ে প্রতি বছর নোবেল পুরস্কার (Nobel Prize) ঘোষণার সময়। আজ আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রকাশিত হতে চলেছে চলতি বছরের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার বিজেতার নাম। বর্তমানে শরণার্থী সমস্যা (Immigration) সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো শরণার্থী বিজ্ঞানীই যদি নোবেল পেয়ে যান, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যি বলতে কি, অন্য সময়ে দাঁড়িয়েও এমন ঘটনায় অবাক হওয়ার কিছু নেই। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, এনরিকো ফার্মি বা অটো স্টার্নের মতো বিজ্ঞানীদের কথা তো আমরা সবাই জানি। তবে শুধু এঁরাই নন। পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ীদের এক চতুর্থাংশের বেশিই নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছেন। সম্প্রতি উঠে এসেছে এমনই তথ্য।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার প্রাক্কালে মার্কিন বিজ্ঞান সাংবাদিক হামিশ জনস্টন তাঁর ‘ফিজিক্স ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকায় এমনই এক পরিসংখ্যান প্রকাশ করলেন। অবশ্য এই পরিসংখ্যান তৈরির কাজ তিনি শুরু করেছেন ২ বছর আগেই। সেখানে দেখা গিয়েছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ২১৫ জন পদার্থবিদকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেউ এককভাবে পেয়েছেন, কেউ পেয়েছেন যৌথভাবে। তবে তার মধ্যে ৫৬ জনই শরণার্থী। অবশ্য এখানে শরণার্থী শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকতে পারে, সে-কথা স্বীকার করে নিয়েছেন জনস্টন নিজেই। কারণ তিনি এই পরিসংখ্যানে শরণার্থী বলতে বুঝিয়েছেন যে সমস্ত বিজ্ঞানী নিজেদের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে এসে গবেষণা করেছেন। এঁদের অনেকে আবার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে নিজেদের দেশ ছেড়েছেন। যেমন এনরিকো ফার্মি নিজেই ১৯৩৮ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কয়েক মাস পরে পাড়ি দিয়েছিলেন আমেরিকায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই ৫৬ জন বিজ্ঞানীর মধ্যে একটা বড়ো অংশই কিন্তু যুদ্ধ, দাঙ্গা বা অন্য কোনো কারণ ছাড়াই নিজেদের দেশ ছেড়েছেন। বরং এই দেশান্তরের পিছনে সবচেয়ে বড়ো কারণ ছিল উপযুক্ত গবেষণা পরিকাঠামো।
জনস্টনের নিবন্ধে এই একটি বিষয় কোনো কারণে আলোচিত হয়নি। অথচ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট উঠে আসে সেই ছবি। ৫৬ জন দেশান্তরিত বিজ্ঞানীর মধ্যে ৩৪ জনই নিজেদের দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন আমেরিকায়। এর মধ্যে অবশ্যই এনরিকো ফার্মি, আইনস্টাইন বা অটো স্টার্নের মতো বিজ্ঞানীরা ছিলেন, যাঁরা নাৎসি ও ফ্যাসিবাদী উত্থানের সময় দেশ ছেড়েছিলেন। তবে বেশিরভাগের পিছনেই এমন কোনো কারণ ছিল না। বরং এই বিষয়টিকে অর্থনীতির ভাষায় ‘ব্রেন ড্রেইন’ হিসাবে দেখলেই হয়তো সবচেয়ে ঠিক হবে। আমেরিকার পরেই সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সে। এই দুই দেশেই শেষ জীবন কাটিয়েছেন ৬ জন করে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী। অন্যদিকে সুইৎজারল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন ৪ জন। এই ৫৬ জনের মধ্যে অবশ্য সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী এসেছেন জার্মানি (১৪ জন) থেকে। এর পিছনে নাৎসি উত্থান বড়ো ভূমিকা নিয়েছে। তবে বাকি বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছেন ভারতের সুব্রহ্মনিয়ম চন্দ্রশেখর, আবদুস সালামের মতো মানুষ; যাঁরা নিজেদের দেশে গবেষণার পরিকাঠামো না পেয়েই আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন। এছাড়াও অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, আলজিরিয়া বা লুক্সেমবার্গের মতো দেশের বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন। তাঁরাও একইভাবে সুযোগ পাননি নিজেদের দেশে। আর এই বৈষম্য যে শুধু নোবেল প্রাপ্তিকেই প্রভাবিত করে, তা তো নয়। দেশের বিজ্ঞানশিক্ষার বাতাবরনকেও প্রভাবিত করে এই ‘ব্রেন ড্রেইনিং’। তাই বিজ্ঞানের সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনেই এই সমস্যার আশু সমাধান প্রয়োজন।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
নোবেল শান্তি পুরস্কার এবার হু-এর দপ্তরে? চলছে জল্পনা