রকেটে করে পাঠানো হত চিঠি, ভারতেও চালু ছিল এই অদ্ভুত মেইল-পরিষেবা

চিঠির দিন শেষ হয়েছে বহুকাল। আজ তার ব্যবহার সীমাবদ্ধ মূলত অফিস পরিসরে। এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারের যুগে গুরুত্ব হারিয়েছে হাতে লেখা চিঠি। প্রযুক্তির দৌলতে যেখানে মুহূর্তের মধ্যে বার্তা পাঠানো সম্ভব বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে, সেখানে দেশের এক শহর থেকে অন্য শহরে চিঠি পৌঁছাতেই সময় লেগে যায় কয়েকদিন। অবশ্য এইসব বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি আবিষ্কারের বহু যুগ আগেই, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকা থেকে ভারতে চিঠি পাঠানোর এক আশ্চর্য পদ্ধতি একসময় করায়ত্ত করেছিল মানুষ।

হ্যাঁ, মাত্র কয়েক ঘণ্টাতেই সুদূর আমেরিকা থেকে ভারতে পৌঁছাত ডাক। কিন্তু কীভাবে সম্ভব সেটা? এ-দেশ থেকে মার্কিন মুলুকে যাওয়ার দ্রুততম বিকল্প হল বিমানপথ। অথচ, বিমানেও ভারত থেকে আমেরিকা পৌঁছাতে নয় নয় করে লেগে যায় ১৭-২০ ঘণ্টা। তবে? না, এয়ারমেইল-এর কথা হচ্ছে না। বরং, ডাক পাঠানোর এই দ্রুততম পরিষেবার নেপথ্যে ছিল রকেট। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে অতিস্বনক ক্ষেপণাস্ত্র বা সুপারসনিক মিসাইল (Supersonic Missile)। সেই সূত্রেই এই ডাক-ব্যবস্থা (Postal System) পরিচিত ছিল ‘রকেট মেইল’ (Rocket Mail) নামে। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৌজন্যে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই পরিষেবা। যদিও রকেটকে চিঠি পরিবহনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে। 

১৮১০ সাল। কল্পবিজ্ঞান সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে সর্বপ্রথম রকেটের মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর কথা উল্লেখ করেন জার্মান নাট্যকার, আখ্যানকার এবং কবি হেনরিখ ভন ক্লাইস্ট। এই প্রতিবেদনে তিনি হিসেব কষে দেখান, বার্লিন থেকে ব্রেসলিড— এই ১৮০ কিলোমিটারের এই দূরত্ব ঘোড়ার গাড়ির তুলনায় প্রায় ১০ গুণ দ্রুত অতিক্রম করতে পারে রকেট। সেই রকেটের মাথায় পণ্য পরিবহনের বিশেষ প্রকোষ্ঠ তৈরি করতে পারলে, অনায়াসেই চিঠি চালাচালি করা যেতে পারে রকেটের মাধ্যমে।

অবশ্য সে-যুগের রকেট্রি বা রকেট-সংক্রান্ত প্রযুক্তিবিদ্যা সীমিত ছিল কেবলমাত্র আতশবাজির মধ্যেই। ফলে ক্লাইস্টের এই প্রস্তাব বা অনুমানকে সে-যুগে ততটাও গুরুত্ব দেয়নি জার্মান সমাজ। বরং, কেবলমাত্র কল্পবিজ্ঞানের সাহিত্য হিসাবেই গ্রহণ করেছিল জার্মানি। উনিশ শতকের শেষ দিকে ক্লাইস্টের এই তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা শুরু করেন ব্রিটিশ উদ্ভাবক স্যার উইলিয়াম কনগ্রেভ। রকেটের উপরিপ্রান্তে চিঠি পরিবহনের জন্য বিশেষ প্রকোষ্ঠ তৈরি করেন উইলিয়াম। এমনকি পলিনেশিয়ান দ্বীপ টোঙ্গায় এই রকেটের পরীক্ষানিরীক্ষাও শুরু করেছিলেন তিনি। যদিও শেষ পর্যন্ত সাফল্য পাননি তিনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অগ্নিসংযোগ ঘটে যেত প্রকোষ্ঠে সংরক্ষিত চিঠিগুলিতে। পাশাপাশি এই রকেট কোথায় গিয়ে অবতীর্ণ হবে, সে-ব্যাপারেও নিশ্চয়তা ছিল না কোনো। ফলে শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়েন তিনিও।

এর প্রায় তিন দশক পর সফলভাবে পৃথিবীর আকাশে ওড়ে প্রথম ডাক-বাহী রকেট। নেপথ্যে ছিলেন অস্ট্রিয়ান প্রকৌশলী ফ্রেডরিখ শ্মিডেল। অস্ট্রিয়ান আল্পসের দুর্গম অঞ্চলে রকেটের মাধ্যমে অক্ষত অবস্থায় চিঠি পাঠাতে সক্ষম হন তিনি। পাশাপাশি তাঁর রকেটে তিনি সংযুক্ত করেছিলেন বিশেষ ধরনের প্যারাস্যুট। যা মাটি থেকে বেশ কয়েক ফুট উচ্চতায় খুলে যেত। প্রাচীন নথি অনুযায়ী, প্রথম প্রচেষ্টায় ১০২টি চিঠি পাঠিয়েছিলেন স্মিডেল। দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় পাঠানো চিঠির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৩-এ। অবশ্য এই কৃতিত্বের ভাগীদার স্মিডেল একা নন। ১৯২৭ সালে ড্যানজিগের সোসাইটি অফ এরোনটিক্সে জার্মান অধ্যাপক, প্রকৌশলী ও আধুনিক রকেট প্রযুক্তির জনক হার্মান জুলিয়াস ওবার্থের দেওয়া একটি বক্তৃতা এবং গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই স্মিডেল তৈরি করেছিলেন এই ডাকবাহী রকেটকে। 

স্মিডেলের সাফল্যের পর রকেট-মেইল নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা শুরু হয় ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া-সহ বহু দেশে। তালিকাতে ছিল ভারতবর্ষের নামও। যদিও কোনো ভারতীয় জড়িত ছিলেন না এই গবেষণায়। বরং, ভারতে রকেট-মেইলের গবেষণা শুরু হয়েছিল স্টিফেন স্মিথ নামের এক স্কটিশ সাহেবের হাত ধরে। তৎকালীন যুগে ‘রকেট মেইল’ প্রযুক্তির সবচেয়ে সফল প্রকৌশলী হয়ে উঠেছিলেন তিনিই। 

১৯৩৪-১৯৪৪— এই দশ বছরের মধ্যে সবমিলিয়ে ২৭০টি রকেট উৎক্ষেপণ করেন স্মিথ। যার মধ্যে চিঠি ছিল ৮০টিতে। প্রায় ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই চিঠি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। শুধু চিঠিই নয়, রকেটের মাধ্যমে চাল, শস্য, স্থানীয় সিগারেটের প্যাকেজিং-ও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছিলেন তিনি। তিরিশের দশকের শেষের দিকে ভয়াবহ ভূমিকম্পের শিকার হয় পশ্চিম ভারতবর্ষ তথা বর্তমান পাকিস্তানের শহর কোয়েটা। সে-সময় রকেটে করে ত্রাণও সরবরাহ করেছিলেন স্মিথ। ব্রিটিশ ভারতের প্রটেক্টরেট স্টেট সিকিম থেকেই পাঠানো হত এই রকেট-মেইল ও ত্রাণ। আসলে তৎকালীন সিকিমের রাজাই মূলত স্মিথকে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এমনকি রকেট মারফত চিঠি পাঠানোর জন্য তিনি চালু করেছিলেন বিশেষ ডাক টিকিটও। 

ভারত স্বাধীন হওয়ার পর এ-দেশ থেকে ফের ব্রিটেনে পাড়ি দিয়েছিলেন অধিকাংশ অভিজাত শ্বেতাঙ্গই। সেই তালিকাতেই ছিলেন স্মিথ। ফলে, ১৯৪৭ সালের পর তাঁর প্রত্যাবর্তনে বন্ধ হয়ে যায় সিকিমের রকেট মেইল পরিষেবাও। 

এর প্রায় ১২ বছর পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে রকেট মেইল। রেগুলাস ক্রুজ মিসাইলের মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর পরিকল্পনা করে মার্কিন ডাক বিভাগ। পারমাণবিক বিস্ফোরক-বহনকারী এই ক্ষেপণাস্ত্রের বারুদ ভরার প্রকোষ্টেই ভরা হত চিঠি। ১৩ হাজার পাউন্ড ওজনের এই ক্ষেপণাস্ত্র ৭০০ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় নিত মাত্র ২২ মিনিট। তাছাড়া সর্বোচ্চ ২০০০ মাইল পথ অতিক্রম করতে সক্ষম ছিল এই গাইডেড মিসাইল। ‘গাইডেড’ অর্থে পূর্বনির্ধারিত কোনো স্থানেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবতীর্ণ হত এই মিসাইল রকেট। ১৯৫৯ সালে সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠায় এই পদ্ধতিতে। সেবার ফ্লোরিডার নৌ-ঘাঁটি মেপার্টে সবমিলিয়ে পাঠানো হয় প্রায় ৩০০০ চিঠি। কয়েক বছরের মধ্যে এই পরিষেবা উপলব্ধ করে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের জন্যেও। তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ ডাক বিভাগও। ইউরোপ তো বটেই, বেশ কয়েকটি ধাপে রকেটে করে চিঠি পাঠানো হত ভারতেও। 

যদিও খুব বেশি দিন চলেনি যুক্তরাষ্ট্রের ‘রকেট মেইল’ পরিষেবা। তার অন্যতম কারণ হল খরচ। সাধারণত, একটি রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য সে-সময় খরচ পড়ত প্রায় ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার। সে প্রেক্ষিতে ‘রকেট মেইল’-এর ডাকটিকিট বিক্রি থেকে খরচ উঠত মাত্র ২৪০ ডলার। ফলে, এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি এড়াতেই অল্পদিনের মধ্যেই পরিষেবা বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। সে-যুগে রকেট মেইলের জন্য বিশেষভাবে ছাপা কিছু ডাকটিকিট ও পোস্ট কার্ডই আজ কেবলমাত্র বিশ্বের বিভিন্ন জাদুঘরে রয়ে গেছে আশ্চর্য এই ইতিহাসের নিদর্শন হয়ে। 

Powered by Froala Editor