সে এক নতুন সূর্যের দিন। প্রায় ৯ মাস ধরে যুদ্ধ চলার পর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে পাক সেনাবাহিনী। আওয়ামী লিগের নেতৃবৃন্দ একে একে ঢাকায় ফিরে এসেছেন। নতুন করে শুরু হল বাংলাদেশের জাতীয় সরকারের কাজ। এবার আর প্রতীকী স্বাধীনতা নয়, সত্যিই জয়লাভ করেছে মুক্তিবাহিনী। দিনটা ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আর সেই বিজয় দিবসের দিনে নবগঠিত বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে বহুদূরে পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলখানায় মৃত্যুর দিন গুনছেন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বেশ কিছুদিন আগেই তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে লাহোর আদালত। ফাঁসির দড়ি তৈরির কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে ততদিনে।
মুক্তিযুদ্ধের (Liberation War) দিনগুলো জেলখানাতেই কেটেছে বঙ্গবন্ধুর (Mujibur Rahman)। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট। আর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। ধানমাণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে ওয়্যারলেসে জানান, “এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।” সেইদিন সকালেই পাক সেনার হাতে গ্রেপ্তার হন মুজিবুর। বন্দি বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানায় রাখা যে নিরাপদ নয়, সেটা বুঝতেই পেরেছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের উষ্ণতম শহর লায়ালপুরের জেলখানায়। তবে বঙ্গবন্ধুর আহ্বান ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন অসংখ্য তরুণ, এমনকি তরুণীরাও সামিল হয়েছেন যুদ্ধে।
এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে মেহেরপুরের আম্রকাননে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। আর সেই সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মুজিবুর রহমান। কিন্তু তিনি যে তখন জেলখানায় বন্দি। তাই উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ীভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এদিকে লাহোর আদালতে ততদিনে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয়ে গিয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধাপরাধী মুজিবুরকে শাস্তি পেতেই হবে। আর এক্ষেত্রে শাস্তি মানেই যে মৃত্যুদণ্ড, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আদালতের সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত সেই সম্ভাবনাকেই প্রমাণ করল। ৭ সেপ্টেম্বর লাহোর আদালত বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডের রায় জানাল। তবে ফাঁসির দিন তখনও স্থির করা হয়নি।
মুজিবুর রহমানের জীবনে কারাবাস কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। জীবনের ৭-৮টি বছর জেলখানাতেই কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু এই শেষবারের কারাবাসে অভিজ্ঞতা বাকিগুলোর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। লায়ালপুর জেলে তিনি সবচেয়ে অবাক হয়েছিলেন, গোটা চত্ত্বরে কোনো বাঙালি জেল কর্মচারীর দেখা পাননি তিনি। পাকিস্তানের প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল তাঁর। তিনি জানতেন, পশ্চিম পাকিস্তানেও বহু বাঙালি কর্মচারী কাজ করেন। তবে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জানতে পারলেন, কাউকেই তাঁর আশেপাশে ঘেঁষতে দেওয়া হবে না। এমনকি বাঙালি কর্মচারীরা কেউ জানেন না যে বঙ্গবন্ধু এই জেলখানায় বন্দি হয়ে আছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া মনে করেছিলেন, প্রত্যেক বাঙালিকেই মাতিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখেন মুজিবুর। আর তাই পাকিস্তানপন্থী কোনো বাঙালিকেও তাঁর আশেপাশে যেতে দেওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন
'আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন, আপনারা সর্বস্ব দিয়ে প্রতিরোধ চালিয়ে যান' : বঙ্গবন্ধু
সেদিন বঙ্গবন্ধু তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালিদের ব্যবহার করে ঠিকই। কিন্তু তাঁদের বিশ্বাস করতে পারে না। তিনি এটাও বুঝেছিলেন, বাঙালিদের বিশ্বাস করলে হয়তো সামরিক সরকারেরই লাভ হত। এই অবিশ্বাসের কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের জয় অনিবার্য। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত তিনি দেখে যেতে পারবেন কি?
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক পুরস্কার ঘোষণা ইউনেস্কোর
মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত দিন স্থির করা যখন বাকি, তখনই যুদ্ধের মোড় ঘুরতে শুরু করল। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেয় ভারতের সেনাবাহিনী। অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ থেকেও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ব্যর্থ হলে রাশিয়ার অপরাজেয় নৌবাহিনী প্রবেশ করত যুদ্ধক্ষেত্রে। তবে ততদূর এগোয়নি যুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতের মিত্রবাহিনীর মিলিত আক্রমণের কাছেই হার মানতে বাধ্য হল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর সেই বিজয় দিবস। এই পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আর ক্ষমতায় থাকতে পারলেন না ইয়াহিয়া খান। ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। তবে তার আগে অনুরোধ করেন, বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির ব্যবস্থা যেন বন্ধ না হয়। ভুট্টোও কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই অনুরোধ রাখতে পারেন না।
আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প
২৭ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করা হয়। বলা হয়, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক শুধু নন, তিনি রাষ্ট্রপতি। আর তাই পাকিস্তান সরকারের কোনো অধিকার নেই তাঁকে শাস্তি দেওয়ার। কিন্তু এই দাবি জানানোর পরই এক অদ্ভুত কথা জানা যায়। জেলখানায় বঙ্গবন্ধু নেই। তাহলে? খোঁজ নিতে শেষ পর্যন্ত জানা যায়, ২২ ডিসেম্বরই বঙ্গবন্ধুকে জেলখানা থেকে সরিয়ে কোনো এক অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে নজরবন্দি অবস্থায় রয়েছেন বঙ্গবন্ধু।
ততদিনে হয়তো সত্যিই মুজিবুরের ফাঁসির ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছিলেন ভুট্টো। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি তখন প্রতিকূলে বইছে। বাংলাদেশে তখনও বন্দি বহু পাক সেনা। বঙ্গবন্ধুর অনৈতিক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তাঁদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। এদিকে বাংলাদেশের স্বাধিকার স্বীকার না করেও উপায় নেই। ভারত, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা সহ নানা দেশ ততদিনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত তাঁকে মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে বাধ্য হন ভুট্টো।
২৯ ডিসেম্বর থেকে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনবার মুজিবুরের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ভুট্টো। শেষ পর্যন্ত ৭ জানুয়ারি তাঁর পাকিস্তান ত্যাগের বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হন। রাত ২টোর সময় রাওয়ালপিণ্ডি বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের দিকে রওয়ানা দেয় বিমান। যাত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করে পরদিনই চলে আসেন দিল্লি। ঢাকায় পা রাখার আগে এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড়ো বন্ধু ভারত সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভোলেননি তিনি। ভারতকে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু বলে উল্লেখ করেন তিনি। এরপর ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে ঢাকার মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু। সেখান থেকে সরাসরি চলে যান রেসকোর্সের মাঠে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা জানাতে তখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর মুক্তিসেনাদল।
তথ্যসূত্রঃ কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান
Powered by Froala Editor