বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণ। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে উৎসব আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে ভীষণভাবে। আর উৎসবের কথা এলেই চলে আসে হরেক রকম খাবারের কথা। বিশেষ করে মিষ্টি। একফালি চাঁদের মতো ঈদের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এরকমই একটি পদ— সেমুই। সেমুইয়ের পায়েস খেতে কে না ভালোবাসে! আর যদি সেটা ঈদের হয়, তাহলে তো কথাই নেই। যুগ যুগ ধরে এভাবেই মিলেমিশে গেছে এরা; তৈরি করেছে একটি নির্দিষ্ট ঘরানা।
হালকা বাদামি রঙের সরু সরু সুতোর মতো বস্তু। খাঁটি ঘিয়ে ভাজা বলে গন্ধও বেরোয় অসাধারণ। তারপর দুধে ফেলে রান্না করলেই তৈরি পায়েস। আজ অবশ্য সেমুইয়ের ব্যবহার পায়েসেই আটকে নেই। অনেক রকম পদ, অনেক বাহার তার। তবে ঈদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খাটো হয়নি এতটুকুও। অনেক জায়গায় এই সেমুইয়ের পায়েস খেয়েই শুরু হয় ঈদ-উল-ফিতর। এবার একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। এই সম্পর্ক যে প্রাচীনকাল থেকে আমাদের দেশে চলে আসছে, তেমনটা নয়। ইতিহাসবিদরা বলেন, উনিশ শতক থেকে সেমুইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ঈদ। তিরিশের দশক থেকে আস্তে আস্তে এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। একসময় এটাই ঈদ উৎসবের অংশ হয়ে যায়।
মুঘল বা নবাবি আমলেও এই সেমুইয়ের ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। তবে অনেকের মতে, গ্রিক ‘সেমিদালিস’ শব্দ থেকে সমিদা ও পরে অপভ্রংশ হয়ে সেমুই বা সামাই এসেছে। সে যাই হোক, সেমুই কিন্তু আদ্যোপান্ত ভারতীয়। সহজে তৈরি করা যায় এবং সস্তা— মূলত এই দুটো কারণের জন্য সেমুইয়ের এত রমরমা। তখনও ছিল, আজও…
তবে শুধু ঈদেই নয়, ধর্মের বেড়া ভেঙে সেমুই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শুধু ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষেই নয়, বছরের অন্যান্য সময়ও তাড়িয়ে উপভোগ করা হয় এই খাবার। সেমুই খাওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার প্রস্তুত প্রণালীও। রয়েছে দীর্ঘ পরম্পরা। আজ অবশ্য সেখানে হানা দিয়েছে প্রযুক্তি। একটা সময় বাংলার বাড়িতে, গ্রামে-গঞ্জে হাতে ঘোরানো কলের সেমুইয়ের খুব প্রচলন ছিল। সবাই একসঙ্গে বসে তৈরিও করত সেসব। এখন আর সেই রীতি দেখা যায় না। দেখা গেলেও, সংখ্যায় খুবই কম। আধুনিক মেশিনেই তৈরি হয় লোভনীয় সেমুই। আস্তে আস্তে পেছনে পড়ে যাচ্ছে হাতে ঘোরানো কল।
এসে গেছে আরও একটা খুশির ঈদ। এসে গেছে সেমুই খাওয়ার মরসুমও। কিন্তু করোনা-আমফান বিধ্বস্ত বাংলায় এ-বছর আর আয়োজন বসবে না। সব জায়গায় এখন ধ্বংস, হাহাকারের ছবি। কোথাও আলো নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই; আবার কোথাও মানুষটাই নেই। ঈদ রয়েছে, রয়েছে সেমুইও। কিন্তু হাসিটা আজ মুছে যাচ্ছে কোথাও গিয়ে।
Powered by Froala Editor