গত বছর সেপ্টেম্বর নাগাদ আফ্রিকায় প্রথম ধরা পড়েছিল করোনাভাইরাসের নবতম রূপ ওমিক্রনের সংক্রমণ। অতি-সংক্রামক এই ভ্যারিয়েন্টের সম্পর্কে চিকিৎসামহলে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছিল সেইসময়ই। কিন্তু তারপরেও ঠেকানো গেল না সেই ভাইরাসের প্রকোপ। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই রেকর্ড গড়ল বৈশ্বিক দৈনিক সংক্রমণের মাত্রা। এখনও অব্যাহত তার দাপট। তবে এসবের মধ্যেই গবেষণাভিত্তিক বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বিতর্কের ঝড় তুলেছে চিকিৎসকমহলে। ওমিক্রন কি আদৌ কোভিডেরই তৃতীয় তরঙ্গ (Third Wave)? নাকি এই সংক্রমণ স্বতন্ত্র একটি মহামারী (Different Pandemic)?
প্রশ্নটা শুনে চমকে ওঠাই স্বাভাবিক। কোভিডের মধ্যেই কি তবে নতুন করে হানা দিল আরও এক মহামারী? কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালের চিকিৎসক এবং ভ্যাকসিন ট্রায়াল বিশেষজ্ঞ ডঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক জানালেন, “ওমিক্রনের জেনোমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে এটা কোভিডেরই অন্য একটি প্রজাতি এবং কোভিডের উৎপত্তি যে জিন থেকে ওমিক্রনের জিন তার সঙ্গেই মেলে।” ওমিক্রন পৃথক কোনো মহামারী কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জা গোত্রের ভাইরাস— এমনটা মানতে নারাজ শুভ্রজ্যোতিবাবু। বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্তের বিজ্ঞানীদের একাংশের অভিমত এমনটাই। এমনকি ওমিক্রন যে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসেরই বিবর্তিত রূপ, কোনো সন্দেহই নেই তা নিয়ে। তবে বিতর্ক কীসের?
এক্ষেত্রে যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির কারণ একটাই। বিবর্তন। হ্যাঁ, ওমিক্রনের বিবর্তনের বিশ্লেষণ করলে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়। রিসেপ্টর-বাইন্ডিং ডোমেন থেকে শুরু করে স্পাইক প্রোটিন— সর্বত্রই রূপ বদলেছে ওমিক্রন। শুধু রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনেই ১৫টি মিউটেশন ঘটেছে ওমিক্রনের। আলফা, বিটা, ডেল্টার মতো কোভিডের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টগুলোর ক্ষেত্রে যেখানে সংখ্যাটা মাত্র ১-২টি। পাশাপাশি ভাইরাসের ‘এস-১’ অংশে ঘটেছে ৩২-৩৭টি বিবর্তন। বদলে গেছে ২৩টির মতো স্পাইক প্রোটিনও। “একটা ভাইরাসের মধ্যে এই বিপুল সংখ্যক মিউটেশন হলে আদৌ কি তার স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে? ফলে এটাকে একটা ফ্রেস ভাইরাস হিসাবে দেখা যেতে পারে”, জানালেন টাকি রুরাল হাসপাতালের চিকিৎসক ডঃ তমোজিৎ গোস্বামী। তমোজিৎবাবুর মতো বহু চিকিৎসক ও গবেষকদের অভিমত এমনটাই। ক্রমাগত চরিত্র বদলাতে বদলাতে ওমিক্রন স্বতন্ত্র একটি মহামারীর রূপ নিয়েছে। আর তার ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই রোগের উপসর্গ এবং চিকিৎসার প্রোটোকলেও এসেছে একাধিক পরিবর্তন।
“এক্ষেত্রে পিঠে ব্যথা, পেট ভার হয়ে থাকার মতো উপসর্গ দেখা দিচ্ছে শুরুতেই”, জানালেন তমোজিৎবাবু। উল্লেখ্য, এই ধরনের উপসর্গগুলি কোভিডের অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের সময় কিন্তু লক্ষ করা যায়নি এর আগে। পাশাপাশি আগের মতো কোভিডের পরিচিত ওষুধগুলি ব্যবহারের ফলে কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ফলে বাদ পড়েছে জিঙ্ক, অ্যাজিট্রোমাইসিনের মতো ওষুধের ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ওমিক্রনের ক্ষেত্রে। তাঁর কথায়, “এই ধরনের ওষুধের ব্যবহারে ব্যাকল্যাশ এফেক্ট আসছে। ফলে প্যারাসিটামল ছাড়া বাকিটা সবটাই সিম্পটোম্যাটিক ট্রিটমেন্ট হচ্ছে ওমিক্রনের।” তার স্থায়িত্বও আগের তুলনায় অনেকটাই কম। সেই কারণে, আইসোলেশন পিরিয়ডের সময়সীমাও কমিয়ে এনে ৭ দিন করেছে সরকার।
আরও পড়ুন
করোনায় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের অনুপ্রেরণা যখন কবিতা
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় অন্য জায়গায়। ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ নেওয়ার পরেও ওমিক্রনে আক্রান্ত হচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এখানেও উঠে আসছে সেই একই বিতর্ক। তবে কি স্বতন্ত্র ভাইরাস হওয়ার কারণেই ওমিক্রনের ওপর কাজ করছে না ভ্যাকসিন? বিষয়টি বিশ্লেষণ করলেন ডঃ শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক, “কোনো ভ্যাকসিনই ১০০ শতাংশ কার্যকর নয়। এমনকি পোলিও ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাও ছিল ৭০ শতাংশ। ১০০ শতাংশ মানুষের যদি ডবল ভ্যাকসিনেশন হয়ে যায়, একমাত্র তাহলেই হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হতে পারে।” পাশাপাশি শুভ্রজ্যোতিবাবু জোর দিলেন আরও একটি প্রসঙ্গে। আর তা হল মৃত্যুর হার। কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল ভারতে, ওমিক্রনের ক্ষেত্রে তার ভয়াবহতা অনেকটাই কম। এমনকি এখনও পর্যন্ত কোনো স্বাস্থ্য সংকটের সম্মুখীনই হতে হয়নি ভারতকে। এর পিছনেও রয়েছে ভ্যাকসিনেরই অবদান। একই অভিমত ডঃ তমোজিৎ গোস্বামীরও, “অধিকাংশ ভ্যাকসিনই তৈরি করা হয়েছিল স্পাইক প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে। সেখানেই একাধিক বিবর্তন হওয়ায় ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও আক্রান্ত হচ্ছেন বহু মানুষ। তবে ওমিক্রনের জিনগত বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকায়, ভ্যাকসিনেশনের কারণে রোগের ফ্যাটালিটি কমেছে অনেকটাই।” অথচ, আফ্রিকার বহু দেশে, যেখানে এখনও অধিকাংশ মানুষ ভ্যাকসিনেশন পাননি সেখানে কিন্তু যথেষ্ট প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে ওমিক্রন। সবমিলিয়ে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতাকে প্রশ্নের মুখে দাড় করানো যায় না কোনোভাবেই।
আরও পড়ুন
করোনা কেড়ে নিল আরও এক শিল্পীকে, প্রয়াত তবলিয়া পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতে ৬৫ শতাংশ মানুষের ভ্যাকসিনেশন হয়ে যাওয়ায় ওমিক্রন ডেল্টার মতো শ্মশান করে তুলতে দেশের পরিস্থিতি, তা একপ্রকার নিশ্চিত। তবে অতিসংক্রামক এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা আকাশ ছুঁতে চলেছে খুব দ্রুতই। এই সংক্রমণকে পৃথক মহামারী নাকি কোভিডেরই এক নতুন তরঙ্গ বলা হবে— তা নিয়ে এখনও তর্ক-বিতর্কের অবকাশ রয়েছে যথেষ্ট। এখন দেখার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই বিষয়ে আদৌ কোনো নিদান দেয় কিনা…
আরও পড়ুন
করোনা মোকাবিলায় দেশের সেরা জেলা হাসপাতাল এম আর বাঙ্গুর
Powered by Froala Editor