১৯৫১ সাল। কলকাতা ময়দান উপচে পড়েছে দর্শকদের ভিড়ে। ক্যালকাটা হকি লিগের ফাইনাল বলে কথা। তা নিয়ে বাঙালির মাদকতা থাকবে না, এও কি হতে পারে? আগের বছরের চ্যাম্পিয়ন ভবানীপুর বনাম মোহনবাগান! ফলে, উত্তেজনায় ফুটছে কলকাতা। কিন্তু সাড়ে চারটে বেজে যাওয়ার পরও খেলা শুরু হওয়ার নাম নেই। ব্যাপার কী? জানা গেল, মোহনবাগানের এক খেলোয়াড় তখনও পর্যন্ত হাজির হতে পারেননি মাঠে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? শেষ পর্যন্ত ১০ জন খেলোয়াড় নিয়েই মাঠে নামল মোহনবাগান। খানিক ক্ষণ বাদেই হার্লে ডেভিডসন চড়ে মাঠে ঢুকলেন শেষ জন। নির্ধারিত সময়ের অনেকটাই অতিবাহিত হয়ে গেছে তখন। দ্রুত ড্রেসিং রুমে থেকে ঘুরে এসেই যোগ দিলেন দলে। আর তারপরেই নতুন মোড় নিল খেলা।
কেশব দত্ত। সংক্ষেপে কেসি দত্ত। পঞ্চাশের দশকে কলকাতার অন্যতম সেনশন ছিলেন তিনি। কিংবদন্তি এই হাফব্যাকের ওপর চোখ বুজেই ভরসা করত কলকাতার বড়ো বড়ো ক্লাবগুলি। ভারতের জাতীয় দলও। হকিতে প্রথম দুটি অলিম্পিক জয়ের নেপথ্যে নায়ক ছিলেন তিনিই। গতকাল নিশ্চুপেই চলে গেলেন এই প্রবাদপ্রতিম হকি তারকা। বার্ধক্যজনিত কারণে ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরেই। গতকাল সন্তোষপুরে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর।
কলকাতা তো বটেই, এমনকি ভারতের ক্রীড়ামহলের কাছেও কেসি দত্তের পরিচিতি একজন বাঙালি হিসাবেই। অথচ তাঁর জন্ম অবিভক্ত পাঞ্জাবে। লাহোরে। ১৯২৫ সালে। স্বাধীনতার ঠিক প্রাক্কালে পাঞ্জাব ছেড়ে মুম্বাইতে চলে আসেন তিনি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে তখন দগ্ধ বাংলা এবং পাঞ্জাব। সেই দাঙ্গাই বাস্তুচ্যুত করে কেসি দত্তকে। মুম্বাইতে সামান্য মাইনের কেরানির কাজ শুরু করেন তিনি। সেইসঙ্গে চুটিয়ে হকি খেলা। পাশাপাশি ব্যাডমিনটন এবং অ্যাথলেটিক্সেও দক্ষ ছিলেন কেশব দত্ত।
লাহোরে থাকাকালীনই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ হয়েছিল। মুম্বাইয়ে আসার পর স্বাধীন ভারতের প্রথম হকি দলে জায়গা পাকা করে নিলেন তিনি। এবারে গন্তব্য সোজা অলিম্পিকের মঞ্চ। ১৯৪৮ সাল সেটা। স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম অলিম্পিক। আর তাতেই গোটা বিশ্বকে চমকে দিল ভারত। দিনটা ছিল ১২ আগস্ট। দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবসের ঠিক তিন দিন আগেই অলিম্পিক ফাইনালে ব্রিটেনের বিরুদ্ধেই জয় ছিনিয়ে নিল ভারত। এ যেন অন্য এক লড়াই। দুশো বছরের পরাধীনতা, ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিশোধ তুলে আনা বিশ্বসেরা হয়ে। আর সেই জয়ের নেপথ্যে ছিলেন স্বর্ণপদকজয়ী কেসি দত্ত। বছর চারেক পর হেলসিঙ্কি অলিম্পিকেও পুনরায় সোনা জয় ভারতের। সেবারেও মাঠ কাঁপিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
মানহানির মামলা ঠুকলেন জেনারেল ডায়ার, প্রহসনের শিকার কেরালার আইনজীবী
১৯৫০ সালে মুম্বাই ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। সেইসময়ে গোটা ভারতের মধ্যে কলকাতা ছিল হকির আঁতুড়ঘর। লেসলি ক্লডিয়াস, চামান সিং গুরুং, বলবীর সিং সিনিয়র— সকলেই তখন তিলোত্তমায়। কলকাতায় এসে ভবানীপুর ক্লাবে যোগ দিলেন কেশব দত্ত। চ্যাম্পিয়নও করলেন দলকে। পরের বছরই ডাক এল মোহনবাগানের থেকে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন খোদ ক্লাব সেক্রেটরি তথা অভিনেতা জহর গাঙ্গুলি। চুক্তিও স্বাক্ষরিত হল। আর তার এক বছরের মধ্যেই ট্রফি তুলল মোহনবাগান।
আরও পড়ুন
গুণমুগ্ধ ছিলেন সত্যজিৎ-উত্তমের, অভিনয়ের তাগিদে শিখেছেন বাংলা ভাষাও
কিন্তু ধারাবাহিক পারফর্মেন্স বজায় রাখলেও, প্রতি ম্যাচেই অত্যন্ত অনিয়মিত ছিলেন তিনি। ম্যাচের শুরু থেকে তাঁর হাজিরার ঘটনা বিরল বললেই চলে। কিন্তু ডিসিপ্লিনের অভাবের কারণ কী? ঔদ্ধত্ব নাকি জাত্যাভিমান? না, কোনোটাই নয়। আসলে পেট চালাতে তিনি তখন কর্মরত কলকাতার এক ব্রিটিশ চা কারখানায়। মাস গেলে মোটা অঙ্কের মাইনে পেতেন ঠিকই, কিন্তু অসম্ভব চাপ নিয়েই কাজ করতে হত তাঁকে। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবের থেকে সাড়ে চারটের আগে ছুটি পাওয়াই দুষ্কর। ফলে প্রতিদিনই মাঠে ঢুকতে দেরি হত তাঁর। তারপরেও দলের ভাগ্য পরিবর্তন করতে তাঁর বিকল্প ছিলেন না কেউ-ই। এক দশকের কেরিয়ারে মোহনবাগানকে এনে দিয়েছিলেন ৬টি লিগ, ৩টি বেটন ক্লাব।
আরও পড়ুন
ফলবিক্রেতা থেকে সটান বলিউডের নায়ক, হয়ে উঠলেন রুপোলি পর্দার 'ট্র্যাজেডি কিং'
১৯৫৬ সালেও অলিম্পিকে সোনা জেতে ভারত। সেবার অলিম্পিক অভিযানের মাস দুয়েক আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল ভারতের দল। অধিনায়ক হিসাবে বোর্ড বেছে নিয়েছিল কেসি দত্তকে। কিন্তু সেবার আর অলিম্পিকে যাওয়া হল না তাঁর। বাধা হয়ে দাঁড়াল কর্মসংস্থান। অলিম্পিকের আগে চূড়ান্ত অনুশীলন হবে দেরাদুনে। আর তার জন্য দরকার দু’মাসের ছুটি। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ করে দিল ব্রিটিশ চা কোম্পানি। তা নাহলে, তিনবার বিশ্বসেরা হয়ে অনন্য এক রেকর্ড তৈরি করার সুযোগ ছিল তাঁর কাছে।
এমন এক ব্যক্তিত্ব নিশ্চুপেই চলে গেলেন গতকাল। কোনো আড়ম্বর নেই। নেই কোনো আলোচনাও। জীবদ্দশাতেই বা কতটুকু সম্মান পেয়েছেন তিনি? অলিম্পিকে ভারতকে দু’বার সোনা এনে দেওয়ার পরও তাঁকে ন্যূনতম কোনো সম্মাননা জানায়নি ভারত সরকার। তবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ ছিল না কেশব দত্তের। ছিল না কোনো আকাঙ্ক্ষাও। বরং, ভারত-চিন যুদ্ধের সময় নিজের অলিম্পিকের দুটি স্বর্ণপদকই তিনি দান করে দিয়েছিলেন সেনা ত্রাণে। কলকাতাই বা কতটুকু মনে রেখেছে কিংবদন্তি এই তারকাকে? এই শহরেই তো তিনি কাটিয়েছেন সারাটা জীবন। হয়ে উঠেছিলেন একজন অদ্যন্ত বাঙালি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে কোনো বিশেষ সুবিধা দিয়ে উঠতে পারেনি কলকাতার প্রশাসনও। প্রিয় মোহনবাগানের থেকে 'রত্ন' পেয়েছেন জীবনের একেবারে সায়হ্নে এসে। ২০১৯ সালে। এ এক অন্ধকার ইতিহাস। নিঃশব্দেই যবনিকাপতন হল সেই অধ্যায়ের…
Powered by Froala Editor