“খেলা নিয়ে সচেতনতা যত বাড়বে, ততই নতুন নতুন খেলোয়াড়ের জন্ম হবে। তাঁরা মেডেল জয়ের দাবিদার হবেন। আবার দেশে অলিম্পিকের মতো আন্তর্জাতিক মেডেল এলে সচেতনতাও বাড়বে। তখন হয়তো আমাদের একটা বাজার তৈরি হবে। আবার আমরা যত উন্নত সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারব, ততই খেলাধুলোর চর্চাটাও উন্নত হবে। সবটাই একটা সুতোয় বাঁধা।” বলছিলেন ‘অলিম্পিয়া স্পোর্টিং হাউস’-এর বর্তমান কর্ণধার শেখরচন্দ্র বসুর ছেলে ঋদ্ধিশেখর।
অলিম্পিয়া স্পোর্টিং হাউস। বৌবাজার এলাকায় নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে ছোট্ট একটা খেলার সরঞ্জামের দোকান। অথচ তার কোণে কোণে লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। দোকানে ঢুকতেই সামনে চোখে পড়বে সারি সারি বাঁশের তৈরি বর্শা বা জ্যাভলিন। হ্যাঁ, যে অস্ত্রকে হাতিয়ার করে অলিম্পিকে অ্যাথলেটিক্সে ভারতের জন্য প্রথম সোনা এনেছেন নীরজ চোপড়া। সেই জ্যাভলিন তৈরিতে ১২৫ বছর ধরে পথ দেখাচ্ছে ‘অলিম্পিয়া স্পোর্টিং হাউস’। শুধুই জ্যাভলিন নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে চলেছে পরীক্ষানিরীক্ষা। দোকানের পরিসর বেশি নয়। তার মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা সমস্ত সরঞ্জাম। ক্রেতাদের জন্য দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও নেই সেভাবে। আর সেইসব সরঞ্জামের মধ্যেই উঁকি দিচ্ছে কয়েকটা বই। কীসের বই? প্রশ্ন করায় শেখরচন্দ্র উত্তর দিলেন, “ওসব খেলার সরঞ্জাম তৈরির কৌশল নিয়ে। বাড়িতেই আছে বেশি। এখানে তো তেমন জায়গা নেই। তবু কয়েকটা বই রেখে দিই, মাঝে মাঝে দোকানে বসেও যাতে পড়তে পারি।”
এই দোকান তো তাঁদের কাছে শুধুই ব্যবসা নয়। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসার জায়গা। আর তাই রসায়নে পিএইচডি করেও শেখরচন্দ্র পৈতৃক ব্যবসার হাল ধরতে এগিয়ে এসেছেন। তাঁর ছেলে ঋদ্ধিশেখরও এই ব্যবসাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। ঋদ্ধি জানালেন, “ভারতে প্রথম ফাইবার-গ্লাস গোলপোস্টের নির্মাতাও আমার বাবা। মেসি যখন কলকাতায় আসে, তখন বিশেষভাবে তৈরি করা হয় সেই গোলপোস্ট। এদেশে তো কেউ ফাইবার-গ্লাসের গোলপোস্ট বানাতে জানেন না। বাবা কারখানাগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলে পুরো ব্যবস্থাটা করেছিলেন।” তবে আজও মূলত জ্যাভলিন তৈরিকেই অক্ষ হিসাবে ভাবেন তাঁরা। যার শুরুটা হয়েছিল বিশ শতকের শুরুতে। এর আগে ১৮৯৬ সালে, অর্থাৎ আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম বছরেই তৈরি হয়েছিল দোকান। তবে সেই সময় মাছ ধরার ছিপ তৈরি দিয়ে। শেখরচন্দ্রের বাবা বিভূতিভূষণ বসুকে জ্যাভলিনের ব্যবসায় নিয়ে আসেন তাঁর সম্পর্কিত কাকা সরোজ ঘোষ। সারা দেশের নানা স্থানে কী ধরনের বাঁশ জন্মায়, তার একটা বিশদ মানচিত্রও বানিয়েছিলেন তিনি। দেশীয় বাঁশের পাশাপাশি বার্মা থেকে আমদানি করা হত বাঁশ। এখনও হয়। তারপর সেইসব বাঁশ গরম জলে পুড়িয়ে তৈরি হয় জ্যাভলিন।
আরও পড়ুন
মাত্র ৫ জন প্রতিযোগী নিয়েই তিনটি পদক, অলিম্পিকজয়ী ক্ষুদ্রতম দেশের গল্প
“এখন অবশ্য আন্তর্জাতিক বা জাতীয় স্তরের খেলায় আর বাঁশের জ্যাভলিন ব্যবহার করা হয় না। নানারকম শঙ্করধাতু দিয়ে তৈরি হয় জ্যাভলিন। এতে অনেক বেশি নিখুঁতভাবে সমস্ত বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা হয়তো সহজ, কিন্তু বাঁশের জ্যাভলিন শেখার জন্য আদর্শ।” বলছিলেন ঋদ্ধিশেখর। বিশেষ করে বাজারে পাঞ্জাব বা চিনের তৈরি জ্যাভলিনের দাম যখন কয়েক হাজার টাকা, তখন অলিম্পিয়ার বাঁশের তৈরি জ্যাভলিন পাওয়া যায় মাত্র ৪০০-৫০০ টাকায়। একটা সময় সারা দেশেই জ্যাভলিন রপ্তানি করত অলিম্পিয়া। এখন সেই বাজারটা আস্তে আস্তে হারিয়েছে। জ্যাভলিনের পাশাপাশি অলিম্পিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য ‘আর্চারি স্পোর্টস ইকুইপমেন্টস’। বাঁশের তৈরি তীর-ধনুকের চাহিদাও একসময় ছিল প্রচুর। অথচ গত দু-তিন বছরে বিক্রি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
আরও পড়ুন
অলিম্পিকে মশাল রিলের ভারতীয় প্রতিনিধি আজ চা-বাগানের কুলি
নীরজ চোপড়ার জ্যাভলিনে সোনা জয় কি এই ব্যবসায় খানিকটা বাতাস দিতে পারবে? এই বিষয়ে অবশ্য তেমন আশাবাদী নন শেখরচন্দ্র। তিনি বলেন, “দুদিন মানুষ মনে রাখবে। আবার ভুলে যাবে। ট্রাক অ্যান্ড ফিল্ড গেম নিয়ে আমাদের এখানে কোনোদিনই তেমন চর্চা হয়নি।” অন্যদিকে ঋদ্ধিশেখর বলছেন, ইতিমধ্যে অনলাইনে বেশ কয়েকজন যোগাযোগ করেছেন তাঁদের সঙ্গে। অনেকেই ছেলেমেয়েদের এই খেলায় উৎসাহিত করতে চাইছেন। গত এক সপ্তাহে সংখ্যাটা প্রায় ৫০ ছুঁয়েছে। এর মধ্যে কেউ কেউ তো সত্যি সত্যি খেলার দুনিয়ায় পা রাখবে। তাই পরিস্থিতি কিছুটা বদলানোর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে পাশাপাশি তিনি বলছেন, “আমাদের এখানে সবচেয়ে বড়ো অভাব কোচের। শহরাঞ্চলে যদি বা কিছু কোচিং হয়, গ্রাম-মফস্বলে তো একেবারেই হয় না। তার উপর এই করোনা অতিমারী এসে খেলার দুনিয়াটা আরও সংকটময় করে তুলেছে।”
আরও পড়ুন
রেকর্ড সময়ে ম্যারাথন-জয়, শেষ দিনেও বিস্ময়ের সাক্ষী অলিম্পিক
একটা একটা করে ঋদ্ধিশেখর দেখাচ্ছিলেন আরও নানা সরঞ্জাম। মার্শাল আর্টসের জন্য তৈরি কাঠের ডামি, যোগা ম্যাট সবই তৈরি হয় অলিম্পিয়ার নিজস্ব পদ্ধতিতে। আবার দেশবিদেশের বড়ো বড়ো কোম্পানির তৈরি সরঞ্জামও পাওয়া যায় এখানে। আক্ষেপ প্রকাশ করে ঋদ্ধিশেখর বলেন, “অনেক জিনিস আমাদের নিজেদের তৈরির গুণমান অনেক ভালো। কিন্তু তার দাম বেশি হওয়ায় ক্রেতারা বিদেশি জিনিসটাই নিয়ে যান।” এই আক্ষেপের মধ্যেও লড়াই ছাড়তে রাজি নন কেউই। ইতিহাসকে ধরে রাখা এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকে এগিয়ে নিয়ে চলাই একমাত্র লক্ষ্য তাঁদের।
Powered by Froala Editor