গত অলিম্পিকে, ইকুয়েস্ট্রিয়ানে প্রথমবারের জন্য অংশ নিয়েছিলেন কোনো ভারতীয় অশ্বারোহী— ফাওয়াদ মির্জা। অথচ, খেলাধুলোর সঙ্গে অসীম আবেগ জড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কলকাতার কতজন মানুষ খবর রেখেছেন তার? আম-বাঙালির মনে অশ্বারোহণ বলতে এখনও রেস কোর্স, ঘোড় দৌড়ের বাজি আর সুভাষচন্দ্রের মূর্তি। এর বাইরে নৈব নৈব চ। তবে অবাক করার বিষয় হল, বিশ্বের প্রাচীনতম পোলো ক্লাব রয়েছে এই তিলোত্তমার বুকেই।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। পোলো (Polo)। যে খেলা রয়্যাল স্পোর্ট বলেই বিবেচিত হয় ব্রিটিশ মুলুকে। যে খেলায় অভ্যস্ত প্রিন্স চার্লস থেকে শুরু করে হ্যারিও। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পোলো জন্ম হয়েছিল ভারতেই। আরও বিশেষভাবে বলতে গেল পূর্ব-ভারতের মণিপুরে। ঘোড়ার পিঠে চেপে সেখানকার মানুষরা কাঠের বল নিয়ে খেলতেন এক অদ্ভুত খেলা। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ‘সাগোল কাংজেই’ বা ‘পুলু’। শুধু মণিপুরই নয়, ভারতের অন্যান্য প্রান্তে রাজা-রাজরারাও অবসর কাটাতে মজতেন পোলোতে। সে যাই হোক, ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের কাছে সেই খেলাই হয়ে উঠল ‘পোলো’। ব্রিটিশ মহলে তার জনপ্রিয়তাও কম ছিল না। আর প্রাচীনতম পোলো ক্লাব?
হ্যাঁ, সেই মূল প্রসঙ্গেই এবার ফেরা যাক বরং। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের কথা। তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা (Kolkata)। এই তিলোত্তমার বুক থেকেই পরিচালিত হত গোটা ভারতের গতিবিধি। কাজেই কলকাতা থেকে মণিপুরে গিয়ে পোলো খেলাটা খানিক বাতুলতা হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই অনুসন্ধান শুরু হয় বিকল্পের।
১৮৬২ সাল সেটা। দুই ব্রিটিশ মেজর— ক্যাপ্টেন রবার্ট স্টুয়ার্ট এবং জো শেরার উদ্যোগ নেন কলকাতার বুকেই একটি পোলো ক্লাব তৈরির। যেখানে শুধু পোলো খেলাই নয়, থাকবে এই খেলা অনুশীলন করার মতো পর্যাপ্ত পরিকাঠামোও। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কলকাতার রেস কোর্সের বুকেই গড়ে উঠল আস্ত একটি ক্লাব— ক্যালকাটা পোলো ক্লাব। বিশেষ করে শীতের আমেজে সরগরম হয়ে উঠত এই ক্লাব।
আরও পড়ুন
আইরিস ক্লাবের জার্সিতে বব মার্লের হাস্যমুখ, ফুটবলের সঙ্গে হাত মেলাল সঙ্গীত!
শুধু ব্রিটিশরাই নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের খাতনামা ব্যক্তিত্বরাও খেলতে আসতেন কলকাতায়। এমনকি বাঙালিরাও রীতিমতো সিদ্ধাহস্ত ছিল এই খেলাতে। পোলোর মাঠে বাঙালি দর্শকদের ভিড়ও খুব একটা কম থাকত না। পোলোর সঙ্গে জুড়ে রয়েছে আরও এক কিংবদন্তি। কোচবিহারের রাজকুমারী তথা জয়পুরের মহারানি গায়ত্রী দেবী স্বয়ং পোলো খেলা দেখে প্রেমে পড়েছিলেন জয়পুরের মহারাজ সওয়াই সিং-এর। আর সেটা এই কলকাতার বুকেই।
আরও পড়ুন
ফুটবল ক্লাবের নাম ‘বেঙ্গল’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রাজত্ব বাঙালিদের?
যাক সে কথা। আবার ফেরা যাক, পোলোর দুনিয়ায়। শুধু ক্লাবই নয়, বিশ্বের প্রাচীনতম পোলো প্রতিযোগিতা ও ট্রফির জন্মও হয়েছিল কলকাতায়। উনিশ শতকের সত্তর-আশির দশকে তিলোত্তমায় পোলোর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিলেন ইহুদি বণিক স্যার ডেভিড জোশেফ এজরা। যাঁর নামে বড়োবাজার মার্কেটের কাছেই রয়েছে ‘এজরা স্ট্রিট’। ‘সিটি অফ জয়’ কলকাতার একাধিক ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়ান ভবন ও অন্যান্য নির্মাণের পিছনেও রয়েছে তাঁর অনস্বীকার্য অবদান। কলকাতায় বাণিজ্য করতে এসে পোলোর নেশা চেপে ধরেছিল তাঁকেও। তিনিই আয়োজন করেন বিশ্বের প্রথম পোলো টুর্নামেন্টের— এজরা কাপ। সেটা ১৮৮০ সাল। পাশাপাশি রেসকোর্সে পোলো খেলার অত্যাধুনিক পরিকাঠামোও তৈরি করেছিলেন স্যার ডেভিড এজরা।
আরও পড়ুন
প্রেমে প্রত্যাখ্যাত পুরুষদের জন্য কলকাতায় গড়ে উঠেছিল ‘জবাব ক্লাব’!
এজরা ছাড়াও, বিশ্বের প্রাচীনতম ১০টি পোলো ট্রফির মধ্যে রয়েছে এমন আরও দুটি ট্রফি যাদের জন্ম এই তিলোত্তমাতেই। সেগুলি হল কারমাইকেল কাপ (১৯১০) এবং স্টুয়ার্ট কাপ (১৯৩২)। তাছাড়াও ১৯০৭ সালে প্রথম ভারতীয় পোলো অ্যাসোসিয়েশন চ্যাম্পিয়নশিপও আয়োজিত হয়েছিল ক্যালকাটা পোলো ক্লাবেই।
কিন্তু এ-সব কি শুধুই ইতিহাস? না, সময়ের স্রোতে এখনও ধুয়ে মুছে যায়নি এই ক্লাব। আজও টিম টিম করে জ্বলে রয়েছে ক্যালকাটা পোলো ক্লাবের বাতি। গুটি কয়েক বাঙালি আজও প্রশিক্ষণ নিতে যান পোলোর। তবে বিনিয়োগ এবং পরিকাঠামোর অভাবে ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছে চৌরঙ্গী রোডের রেস কোর্সের কেন্দ্রে অবস্থিত শহরের এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কজনই বা খোঁজ রেখেছে তার?
Powered by Froala Editor