অবাক হচ্ছেন? অবাক হওয়ার মতো ঘটনাই বটে! কিন্তু ইতিহাসকে অস্বীকার করার উপায় নেই। আজ থেকে ৭২১ বছর আগে, ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে তৈরি হয় বাংলার প্রথম মসজিদ। সেই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সপ্তগ্রামের শাসনকর্তা জাফর খাঁ গাজী। আর সেখানে গেলেই দেখতে পাবেন অসংখ্য হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, সংস্কৃতে লেখা শিলালিপি। এর পেছনে লুকিয়ে রয়েছে বাংলার সে-সময়ের এক বৈচিত্র্যময় ইতিহাস।
আরও পড়ুন
পাঁচালির হাত ধরে 'লক্ষ্মীবিবি' ঢুকে পড়েন মুসলমানের ঘরেও
ত্রিবেণী দীর্ঘদিন ধরেই বাংলার একটি উল্লেখযোগ্য জনপদ। ভাগীরথী-যমুনা-সরস্বতীর মিলনস্থল হিসেবে ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়াও, শিক্ষার ক্ষেত্রেও ত্রিবেণী ছিল এগিয়ে। তৎকালীন বাংলায় সংস্কৃত শিক্ষার জন্য নবদ্বীপ, ভাটপাড়া, গুপ্তিপাড়া ও ত্রিবেণী বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এই ত্রিবেণীরই প্রথম মুসলমান শাসনকর্তা জাফর খাঁ গাজী। ১২৯৮ থেকে ১৩১৩ – দীর্ঘ পনেরো বছর শাসন করেন তিনি। ১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার সর্বপ্রাচীন মসজিদ, যা ‘জাফর খাঁ গাজীর মসজিদ’ নামে পরিচিত। পাশেই দরগা, যা গড়ে ওঠে ১৩১৫-তে। আর এই মসজিদ ও দরগাতেই দেখতে পাওয়া যায় অসংখ্য হিন্দু নিদর্শন। কিন্তু একটি মসজিদে এসব এল কী করে?
যে শাসক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ বানালেন, তিনিই আবার গঙ্গাপূজারী
সেই ইতিহাস অবশ্য খুব একটা সুখকর নয়। ঐতিহাসিকরা বলেন, যেখানে জাফর খাঁ মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে নাকি আগে একটি হিন্দু মন্দির ছিল। সেই মন্দির ধ্বংস করেই তার উপাদান দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন জাফর খাঁ। গঙ্গার ধারের পাঁচিলের পাথরগুলোয় বহু হিন্দু দেবদেবীর অঙ্গহীন মূর্তি আঁকা আছে – দেখতে পাওয়া যায় এমনটাই। এছাড়াও, পরবর্তীকালে নির্মিত দরগার খিলানেও দেখতে পাওয়া যায় বহু মূর্তি। এছাড়াও দরগার ভিতরের সমাধি কক্ষে বেশ কয়েকটি সংস্কৃত শিলালিপিও রয়েছে, যাতে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা আঁকা ও পরিচয় লেখা। এছাড়াও দরগায় রয়েছে বিষ্ণুমূর্তি, বুদ্ধমূর্তি ও জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তিও। ধ্বংসের হাত ধরে হলেও, ভারতবর্ষের চারটি প্রধান ধর্ম মিলেমিশে আছে এখানে।
‘কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’ বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে স্পষ্টই লেখা – ‘Curiously enough, it is not at Gaur, but at Tribeni in the Hughli District, that the oldest remains of Muslim buildings have survived. These are the tomb and mosque of Zafar Khan Ghazi. The former is built largely out of the materials taken from a temple of Krishna, which formerly stood on the same spot but now so multilated as to have lost most of its architectural value.’
তবে এই ইতিহাস শুধু হিন্দুবিদ্বেষেরই নয়। মিলনেরও এক অদ্ভুত রসায়ন খুঁজে পাওয়া যায় জাফর খাঁ গাজীর জীবনে। দরগায় জাফর ছাড়াও বেশ কয়েকটি সমাধি রয়েছে, যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাফরের তৃতীয় পুত্র বর খাঁ গাজী ও তাঁর হিন্দু স্ত্রী, হুগলির রাজকন্যার সমাধি। জাফর খাঁ-র এই পুত্রবধূ ছিলেন গঙ্গাদেবীর ভক্ত। তাঁর প্রভাবেই জাফর খাঁ গঙ্গার প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়েছিলেন। এমনকি, জাফর খাঁ গঙ্গাদেবীর পূজাও করতেন।
এ-পর্যন্ত তাও মানা যায়। কিন্তু আশ্চর্য হবেন একটি সংস্কৃত শ্লোক শুনলে। বলা হয়, গঙ্গার স্তবের এই শ্লোক স্বয়ং জাফর খাঁ গাজীর রচিত। শ্লোকটি হল –
যৎতক্ত্যং জননী-গণৈর্ষদপি ন স্পৃষ্টং সুহৃদ্বান্ধবৈ-
যস্মিন পান্থ দিগন্ত সন্নিপতিতে তৈ স্মর্য্যতে শ্রীহরি।
স্বাষ্কে নস্য তদীদৃশং বপুরহো সংনীয়তে পৌরুষং
ত্বং তাবৎ করুণাপরায়ণপরা মাতাসু ভাগীরথী।
শ্লোকটি জাফরের লেখা – এমন প্রবাদ প্রচলিত হলেও, এটি আসলে বেদব্যাস রচিত গঙ্গাষ্টক স্তোত্র। জাফর সবসময় এই শ্লোকটি আওড়াতেন বলে, তাঁর নামে প্রসিদ্ধি পেয়েছে এটি।
এসব তথ্যের থেকে দূরে গিয়েও অবাক
হওয়া থামে না আমাদের। যে শাসক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ বানালেন, তিনিই আবার
গঙ্গাপূজারী – এই বৈচিত্র্য বিভেদের মধ্যেও মিলনের কথাই বলে। গঙ্গাতীরবর্তী
ত্রিবেণীতে এমনই ইতিহাস রচিত হয়েছিল অতদিন আগে, এক মুসলমান শাসকের হাত ধরে।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা মুকুন্দরাম চক্রবর্তীও অস্বীকার করতে পারেননি তা।
লিখেছিলেন –
‘পাজোয়ায় বন্দিয়া যাবো শুভি খাঁ পীরে।
দফর খাঁ গাজীরে বন্দো ত্রিবেণীর ধারে।।’
বাংলার প্রথম মসজিদ নির্মাতা হিসেবেই নয় শুধু, এক কৌতূহলী চরিত্র হিসেবেও জাফর(ওরফে দফর) যে বারবার আলোচিত হবেন ইতিহাসে – এ-নিয়ে সংশয় কোনো আছে কি?
ছবি ঋণ - wikimapia.org