আজ থেকে প্রায় ২১০০ বছর আগের কথা। নক্ষত্রের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে গ্রিক জ্যোতির্বিদ হাইপারকাস (Hipparchus) তৈরি করেছিলেন আকাশের এক আশ্চর্য মানচিত্র (Map Of The Stars)। তা দিয়ে অনায়াসে দিক-নির্ণয় করতে পারতেন সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি প্রতিটি নক্ষত্রের সম্পর্কে পৃথকভাবে তথ্যও লিখে গিয়েছিলেন হাইপারকার। গ্রিক তো বটেই, রোমান এবং সিরিয়ান সাহিত্যের একাধিক নথিতেও উল্লেখ পাওয়া যায় এই মানচিত্রের। তবে এতদিন পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের ধারণা ছিল কালের আবহেই হারিয়ে গেছে সেই ঐতিহাসিক মানচিত্রটি। প্রায় দু’হাজার বছর পর এবার আবিষ্কৃত হল হাইপারকাসের তৈরি সেই মানচিত্রের এক প্রাচীন অনুলিপি।
‘ল্যাডার অফ দ্য ডিভাইন অ্যাসেন্ট’-খ্যাত সদ্য-আবিষ্কৃত অনুলিপিটি তৈরি হয়েছিল আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে। নেপথ্যে, সিরিয়ান সন্ত জন ক্লিমাকাস। তবে শুধু ক্লিমাকাসই নয়, গ্রিক বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও ভূবিদ হাইপারকাসের তৈরি ‘স্টার ক্যাটালগ’-টি অনূদিত হয়েছিল একাধিক ভাষায়। সেই তালিকায় রয়েছে রোম, মিশর এমনকি তুরস্কের প্রাচীন সভ্যতারাও।
দশম কিংবা একাদশ শতকে মিশরের মাউন্ট সিনাই-এর সেন্ট ক্যাথরিনের মঠের একজন সন্ত দিক নির্ণয়ের জন্য সিরিয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন জন ক্লিমাকাসের তৈরি অনুলিপিটি। সেটিকে ‘ভেলাম’ অর্থাৎ পার্চমেন্ট কাগজের পাতায় সংরক্ষিত করেন তিনি। অবশ্য পার্চমেন্ট কাগজে এই নথি সংরক্ষণ করার কারণে, ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে কালি। আবছা হয়ে গেছে তার লেখা। আর সেই কারণেই প্রাচীন এই নথি চিহ্নিত করতে দীর্ঘদিন সময় লেগে গেল গবেষকদের।
উল্লেখ্য, হাইপারকাসের তৈরি প্রাচীন মানচিত্র ছিল মূলত একটি প্যালিম্পসেস্ট। অর্থাৎ, পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন তারার ছবি আঁকা হয়েছিল একাধিক কাগজে। সেগুলিকে উপরিপাতিত করলে তবেই ফুটে উঠত সমগ্র নক্ষত্রমণ্ডলের ছবি। তার নিরিখেই দিকনির্ণয় করতে হত যাত্রী বা বিজ্ঞানীদের। বিগত শতকে মিশর থেকে সংগৃহীত বেশ কিছু নথি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল গবেষকদের। তবে অর্থবহ কোনো মানে উদ্ধার করতে ব্যর্থ হন গবেষকরা। সম্প্রতি ২০১৩, ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮ সালে খুঁজে পাওয়া এইধরনের একাধিক নথি ও কাগজ উপরিপাতিত করে কম্পিউটারের মাধ্যমে মাল্টিস্পেকট্রাল ইমেজিং তৈরি করেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেন্ডেল হাউসের বিজ্ঞানীরা। আর তাতেই রহস্যভেদ হয় এই জটিল ধাঁধাঁর। সামনে আসে অন্তর্নিহিত পাঠ্যটি।
বর্তমানে মূল পাঠ্যটিকে আলাদাভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেই জানাচ্ছেন গবেষকরা। সিরিয়ান পাঠ্য হওয়ায় ঐতিহাসিক এই মানচিত্রের জায়গা হবে ‘মিউজিয়াম অফ দ্য বাইবেল’-এর সংরক্ষণাগারে। এই প্রতিবেদনের শেষে এসে আরও একটি মজার তথ্য দিয়ে রাখা যাক বরং। হাইপারকাসের প্রায় তিনশো বছর পর, আরও এক প্রাচীন জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ টলেমিও পৃথকভাবে তৈরি করেছিলেন এ-ধরনের তারকা-মানচিত্র। সাম্প্রতিক গবেষণা এবং বিজ্ঞানীদের অভিমত, বহুক্ষেত্রে টলেমির থেকেও বেশি সুনির্দিষ্ট এবং নির্ভুল ছিলেন গ্রিক জ্যোতির্বিদ হাইপারকাস…
Powered by Froala Editor