পশ্চিম লন্ডনের রিজেন্ট স্ট্রিট। এই রাস্তাকে গোটা লন্ডন (London) শহরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল অঞ্চল বললেও ভুল হয় না এতটুকু। শপিং হাব, স্ট্রিট ফুট কিংবা বিলাসবহুল রেস্তোরাঁর জন্য কলকাতার এসপ্ল্যানেডের যেমন নাম রয়েছে, লন্ডনের কাছে রিজেন্ট স্ট্রিট ঠিক তেমনই। আর এই রাস্তা ধরে হাঁটলে চোখে পড়বে এক আশ্চর্য রেস্তোরাঁ (Restaurant)। ঝাঁ চকচকে সেই রেস্তোরাঁর সামনে বড়ো বড়ো হরফে লেখা রয়েছে ‘বীরস্বামী’ (Veeraswamy)।
নাম শুনে ভ্রূ কুঁচকে যাওয়াই স্বাভাবিক। সাধারণত এ-ধরনের নাম দেখা যায় দক্ষিণ ভারতে। তবে কি লন্ডনের বুকে কোনো ভারতীয় ব্যবসায়ী স্থাপন করেছেন এই রেস্তোরাঁ? না, তেমনটাও না। তবে এ-দেশের বাইরে লন্ডনের ‘বীরস্বামী’-ই বিশ্বের প্রাচীনতম ভারতীয় রেস্তোরাঁ। এমনকি লন্ডনের প্রাচীনতম ৩টি রেস্তোরাঁর মধ্যেও একটি।
‘বীরস্বামী’-র গল্পে যাওয়ার আগে, রিজেন্ট স্ট্রিটের কথা বলে নেওয়া যাক খানিক। আসলে গোটা অঞ্চলটার সঙ্গেই আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। ১৮১৯ সাল। এই আশ্চর্য রাস্তাটি তৈরি করেছিলেন প্রিন্স রিজেন্ট। যাঁকে আমরা চিনি রাজা চতুর্থ জর্জ নামে। তৎকালীন সময়ে সেন্ট জেমসের প্রাসাদ পুনর্নিমাণের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল বিস্তীর্ণ অঞ্চল। উচ্ছেদিত করা হয় বহু স্থানীয় ব্যবসায়ীকে। তাঁদের পুনর্বাসনের জন্যই পিকাডিলি সার্কাস থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে এই শপিং হাব গড়ে তোলেন প্রিন্স রিজেন্ট। আর এই অঞ্চলের নকশা তৈরি করেছিলেন কিংবদন্তি ব্রিটিশ স্থপতি জন ন্যাশ।
এবার ভারতীয় প্রসঙ্গে ফেরা যাক বরং। ১৮৮০ সাল। ভারত থেকে লন্ডনে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়ন করতে যান এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি। নাম এডওয়ার্ড পামার। এডওয়ার্ড খাতায়-কলমে ব্রিটিশ নাগরিক হলেও, জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এ-দেশেই। এডওয়ার্ডের পরিচয় জানলেও খানিক আশ্চর্য হতে হয় বৈকি। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম পামারের প্রপৌত্র তিনি। উইলিয়াম বিবাহ করেছিলেন এক ভারতীয় মুঘল রাজকুমারী ফাইসান নিসা বেগমকে। সেই সূত্রেই ভারতীয় রক্ত পেয়েছিলেন এডওয়ার্ড। তাছাড়া তিন পুরুষ ধরে থেকেওছেন এ-দেশে। হায়দ্রাবাদে। ফলে, ভারতীয় সংস্কৃতিতেও যথেষ্ট সাবলীল ছিলেন তিনি।
আজীবন ভারতীয় খাবার খেয়ে, ব্রিটিনে গিয়ে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছলেন এডওয়ার্ড। লন্ডনের লোকেরা নাকি আচার, চাটনি খেতেই জানে না! লন্ডনের মানুষকে এইসব ভারতীয় খাবারের স্বাদ দিতেই একটি ঘরোয়া উদ্যোগ নেন তিনি। ১৮৯৬ সালে শুরু করেন চাটনি, আচার এবং মশলার পেস্টের ব্র্যান্ড ‘নিজাম’। কিছু দিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তাঁর এই উদ্যোগ। তারপরই জায়গা মিলে যায় রিজেন্ট স্ট্রিটে। ‘নিজাম’ নামের ছোট্ট একটি দোকানও খুলে ফেলেন তিনি। আর আজ সেই দোকানই পরিচিত ‘বীরস্বামী’ নামে।
১৯২৬ সালে প্রথম রেস্তোরাঁর চেহারা নিয়েছিল ‘বীরস্বামী’। অবশ্য এর মাত্র ৮ বছরের মধ্যেই মালিকানার হাতবদল হয়। রেস্তোরাঁটি কিনেছিলেন স্যার উইলিয়াম স্টুয়ার্ড নামের এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ী। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ক্রমশ সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যায় ‘বীরস্বামী’। ভারতীয় খাবারের স্বাদে মুগ্ধ হয়ে তিনিও ব্রিটেন থেকে ছুটে এসেছিলেন ভারতে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিয়োগ করেছিলেন পাচকদের। ৯৬ বছর পেরিয়ে আসার পর আজও বহাল রয়েছে যে প্রক্রিয়া। এখনও এই রেস্তোরাঁর ভাঁড়ার থেকে রান্নাঘর সামলান ভারতীয় বাবুর্চিরাই।
অবশ্য শুধু লন্ডনের সাধারণ মানুষরাই নন, লন্ডনে পা রাখলে সমস্ত খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরাই একবার না একবার ঢুঁ মেরে যান এই রেস্তোরাঁয়। প্রিন্স অফ ওয়েলস থেকে শুরু করে চার্লি চ্যাপলিন— সকলেই ছিলেন এই রেস্তোরাঁর গ্রাহক। এমনকি বর্তমান ডেনমার্কের রাজপুত্র প্রিন্স অ্যাক্সেল লন্ডনে এলে, এই রেস্তোরাঁই হয়ে উঠত তাঁর নিত্যদিনের খানা-দানার জায়গা। ‘বীরস্বামী’ রেস্তোরাঁয় তাঁর জন্য বিশেষভাবে সারাবছর সংরক্ষিত রাখা হত বিয়ার এবং চাটনি। তাছাড়া নেহরু, ইন্দিরা গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বরাও রয়েছেন এই তালিকায়।
কিছুদিন আগের কথা। ‘বেস্ট কুসিনস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ ইনডেক্সে বিশ্বের মধ্যে পঞ্চম স্থান পেয়েছে ভারত। আসলে শুধু প্রকারভেদ বা স্বাদই নয়, লন্ডন থেকে শুরু করে পাশ্চাত্যের ভিন্ন ভিন্ন শহরে ভারতীয় খাবারের রাজত্বই তার অন্যতম কারণ। লন্ডনের ‘বীরস্বামী’ রেস্তোরাঁ ভারতীয় খাবারের সেই রাজত্বেরই অন্যতম প্রতীক…
Powered by Froala Editor