শহরের প্রাচীনতম সমাধি হয়ে কলকাতায় শুয়ে আছেন রেজাবিবি

কথায় বলে, কলকাতার ভেতরে আছে আরও একটা কলকাতা। সত্যিই, এই শহর কত জানা অজানা ইতিহাস বুকে নিয়ে বসে আছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে বিদেশিরাও। তাই কলকাতার গোরস্থানগুলি হেরিটেজের একটা অন্যতম অংশ। আর এই গোরস্থানই কলকাতার ইতিহাস নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করে দিয়েছে। সৌজন্যে রেজাবিবি।

ব্যাপারটা ঠিক কী, সেটা জানতে গেলে একটু পেছনে তাকাতে হবে। কলকাতার আরমেনিয়ান চার্চ সংলগ্ন গোরস্থানের একটি সমাধিতে ১৮৯৪ সালে একটি সমাধিফলক পাওয়া যায়। যেখানে আর্মেনিয়ান ভাষায় কিছু কথা লেখা ছিল। ইংরাজিতে অনুবাদ করলে যার মর্মার্থ দাঁড়ায়—

“THIS IS THE TOMB OF REZABEEBEH THE WIFE OF THE LATE CHARITABLE SOOKIAS WHO DEPARTED FROM THIS WORLD TO LIFE ETERNAL ON THE 11TH JULY, 1630.”

অর্থাৎ, এই সমাধিটি দানবীর সুকিয়াসের স্ত্রী রেজাবিবির, যিনি ১৬৩০ সালের ১১ জুলাই মারা যান। আপাত দৃষ্টিতে খুব একটা আশ্চর্য লাগে না। এর আসল বিশেষত্বটি লুকিয়ে আছে মৃত্যুর তারিখে। যেখানে উল্লেখিত সাল ১৬৩০! এদিকে কলকাতার জনক বলে পরিচিত জোব চার্নক শহরে পা দেন আরও ৬০ বছর পরে, ১৬৯০-তে।

উপরের তথ্য থেকে মূলত দুটি বিষয় উঠে আসে। প্রথমত, পুরো কলকাতায় এত পুরনো সমাধি আর পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে আর্মেনিয়ান গির্জা সংলগ্ন অঞ্চলে পাওয়া এই রেজাবিবির কবরই কলকাতার প্রাচীনতম সমাধি।

দ্বিতীয়ত, এই সমাধি কলকাতায় বিদেশিদের আগমনের সময়কাল নিয়ে একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে। বহু আগে থেকেই ইতিহাস বইতে জোব চার্নককেই কলকাতার জনক বলে জেনে এসেছি আমরা(যদিও হাইকোর্টের রায়ে পরবর্তীকালে এ-কথা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে চার্নক কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা নন)। সেই সূত্র ধরে ইংরেজরাই প্রথম কলকাতায় নোঙর ফেলেছিল, সেটাই ধরে এসেছি আমরা। রেজাবিবির সমাধি সেই তথ্যটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। তাহলে কি ইংরেজরা আসার আগেই আর্মেনিয়ানরা কলকাতায় চলে এসেছিল? আর্মেনিয়ানরাই কি কলকাতায় প্রথম আগত বিদেশি?

সমাধিফলকটি আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। নিঃসন্দেহে এটা কলকাতার প্রাচীনতম সমাধি। কিন্তু আর্মেনিয়ানরা কলকাতায় আগত প্রথম বিদেশি সেটা অনেকেই মানতে রাজি ছিলেন না। যে দলে ছিলেন রাধারমণ মিত্রের মতো একজন ইতিহাস গবেষক। তাঁর মতে, যে সমাধিফলকটি পাওয়া গেছে, তা কেবল নিজেরই প্রাচীনত্বকে প্রমাণিত করে। শহরের প্রাচীনত্বকে নয়। এছাড়াও তাঁর যুক্তি ছিল, সেই সময়ের রেজাবিবির কবর ছাড়া আর একটিও পুরনো কবর নেই। বাকি যা আছে সব অষ্টাদশ শতকের আশেপাশের সময়ের। শুধুমাত্র একটা কবর দিয়ে প্রমাণিত হয় না যে ইংরেজদের আগেও আর্মেনিয়ানদের বসবাস ছিল।

তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিক আবার অন্য একটি তত্ত্বকে সমর্থন করেন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, হুগলি নদী দিয়ে তখন আর্মেনিয়ানদের একটি জাহাজ যাচ্ছিল। সেই জাহাজেই ছিলেন রেজাবিবি। জাহাজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসার জন্য পাড়ে নামানো হলে, মারা যান সেখানেই। তারপর, বর্তমান আর্মেনিয়ান চার্চের জায়গায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

প্রসঙ্গত, আর্মেনিয়ান চার্চটি কিন্তু অনেক পরে তৈরি, ১৭২৪ খ্রিষ্টাব্দে। পূর্বে যেখানে আর্মেনিয়ানদের গোরস্থান ছিল, সেখানেই তৈরি হয় চার্চ। আজও সেখানে গেলে চার্চ-সংলগ্ন উদ্যানে অনেক আর্মেনিয়ানের সমাধি ও স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায়।

বিতর্ক ছিল, বিতর্ক থাকবে। আর্মেনিয়ান না ইংরেজ— কে এসেছিল আগে, সেই বিতর্ক থামেনি। শত বিতর্কের মধ্যেও গির্জার চত্বরে চুপ করে শুয়ে থাকেন রেজাবিবি। শহরের প্রাচীনতম সমাধির গায়ে তখন ঢলে পড়ে শেষ সূর্যের আলো।              

Powered by Froala Editor

More From Author See More