ক্যাম্প-পালানো দুই ইহুদি তরুণীকে বাঁচিয়েছিলেন প্রপিতামহ, জানাল পুরনো চিঠি

১৯৪২ সাল সেটা। গোটা ইউরোপ তখন তখন রণক্ষেত্র। বিশ্বযুদ্ধের আগুন জ্বলছে চতুর্দিকে। চলছে নির্বিচারে ইহুদিনিধন। জার্মানি তো বটেই, নাৎসিদের তাণ্ডব থেকে রেহাই মেলেনি অস্ট্রিয়া-পোল্যান্ডেরও। নাৎসি (Nazi) অত্যাচার থেকে বাঁচতে সেসময় শরণার্থী হয়ে দেশ ছেড়েছিলেন হাজার হাজার ইহুদি (Jews)। কিন্তু সেই পথও খুব একটা সহজ ছিল না। ধরা পড়লে নৃশংস মৃত্যুদণ্ডের শিকার হতে হত পলাতকদের।

পোল্যান্ডের (Poland) ওয়ারশ’র মাত্র ৬৮ মাইল পূর্বের গোস্টচর্জ গ্রাম। সেখানে নিজের বাড়ির ফার্মহাউসে খেলতে গিয়েই চমকে উঠেছিল বছর বারোর কিশোর। তাঁদের ফার্ম হাউসে লুকিয়ে রয়েছেন দুই বছর কুড়ির তরুণী। পোশাক এবং বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁরা পালিয়ে এসেছেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে। ফলে, আগ্রহের আগে মনে দানা বেঁধেছিল ভয়। দৌড়ে ডেকে এনেছিলেন বাবা-মাকে। তবে তাঁদের ব্যবহারে বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল সেদিনের সেই কিশোর। না, জার্মান পুলিশকে খবর দেওয়ার বদলে গোপনে অনাথ দুই বোনকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁরা। লুকিয়ে রেখেছিলেন বেশ কয়েক বছর।

শৈশব থেকেই ঠাকুরদার কাছে এই গল্প শুনেই বড়ো হয়েছিলেন সুইডেনের বাসিন্দা ক্যারোলিনা জুরজিক। তবে কোনোদিনই সেই গল্প কিংবা বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা সেভাবে দাগ কাটেনি তাঁর মনে। তবে বছর খানেক আগে নিজের বাড়িতে খুঁজে পাওয়া একটি চিঠিই যেন এক নিমেষে বদলে দিল সবকিছু। না, তাঁর ঠাকুরদা বানিয়ে গল্প বলেননি কোনো। বরং, সত্যি সত্যিই নিজেদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের দরিদ্র কৃষক পরিবারে দুই ইহুদি তরুণীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর প্রপিতামহ। ৬০ বছর আগের এই ধন্যবাদজ্ঞাপনের চিঠি  তাঁদেরই লেখা। 

কিন্তু কেমন আছেন সেই ইহুদি বোনেরা? বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীটাই বা কেমন ছিল তাঁদের কাছে? এইসব প্রশ্নই যেন ঘিরে ধরছিল ৩৫ বছর বয়সী ক্যারোলিনাকে। কিন্তু কে দেবে এই উত্তর? ঠাকুরদা গত হয়েছেন বছর কয়েক আগেই। পোল্যান্ডের সঙ্গেও তাঁদের পরিবারের সম্পর্ক শেষ হয়েছে প্রায় ৬ দশক আগে। তবে কি কোনোভাবেই আর অনুসন্ধান সম্ভব নয় সেই দুই ইহুদি মহিলার?

আরও পড়ুন
৪০ হাজার ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়ে হলোকাস্ট-হিরো জাপানের সুগিহারা

না, হার মানেননি ক্যারোলিনা। বরং, জিনিওলজি ওয়েবসাইট ‘মাই হেরিটেজ’-এ অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন তিনি। তথ্য বলতে, হাতে ছিল কেবলমাত্র দুই তরুণীর নাম— ফেলা এবং জাডজিয়া কেজম্যান। তাঁদের ঠিকানাটুকুও লেখা ছিল না চিঠিতে। তবে দীর্ঘ চেষ্টায় সাফল্য মেলে শেষমেশ। ইহুদি বোনেদের ফ্যামিলি ট্রি খুঁজে পান ক্যারোলিনা। সেখান থেকেই পাওয়া যায় তাঁদের উত্তরসূরিদের ঠিকানা ও ফোন নম্বর। 

আরও পড়ুন
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, উদ্বাস্তু জীবন পেরিয়ে ৯৭ বছরে ঘর পেলেন ইহুদি মহিলা

না, হলোকাস্ট সার্ভাইভারদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি ক্যারোলিনার। বেশ কয়েক বছর আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন জাডজিয়া। আর ফেলা ১০৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন গত ডিসেম্বরেই। তবে, ফেলার উত্তরসূরিদের কাছ থেকে সামনে আসে অলিখিত ইতিহাসের খণ্ডচিত্রটি। জানা যায়, ১৯৪৮ সালে মার্কিন অধিকৃত জার্মানির একটি ক্যাম্পে জায়গা হয়েছিল তাঁদের। তার আগে পর্যন্ত দুই বোন ছিলেন ক্যারোলিনার পরিবারেই। পরবর্তীতে ষাটের দশকে জার্মানি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তাঁরা। 

আরও পড়ুন
ইহুদি যুবকটির হাসি সুন্দর; খুলিতে পাথর ভরে পেপারওয়েট বানালেন নাৎসি চিকিৎসক!

নিজের প্রপিতামহের এই বীরত্বের কাহিনি শুনে নিজেই স্তম্ভিত ৩৫ বছর বয়সী সুইডিস-পোলিশ তরুণী। ইতিমধ্যেই হলোকাস্ট রিমেমবারেন্সে সেন্টারে তিনি আবেদন করেছেন প্রপিতামহের নাম নথিভুক্ত করার জন্যও। যদিও সেই প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘমেয়াদী, তবে শেষ পর্যন্ত তাঁর পূর্বসূরিরা যোগ্য সম্মানটুকু পাবেন বলেই আশাবাদী ক্যারোলিনা। কিন্তু এই গল্প শুধু ক্যারোলিনার পরিবারের নয়। এমন হাজার হাজার মানুষ নিজেদের বিপন্ন করেই প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন বহু ইহুদিদের। সেসব গল্প এভাবেই ধুলোচাপা পড়ে গেছে কালের আবহে… 

Powered by Froala Editor

More From Author See More