বাংলার লোক-সংস্কৃতি বলতে আমরা যা বুঝি, তা সবসময় খুব বেশি পুরনো নয়। উনিশ বা বিশ শতকেই বাংলার গ্রামেগঞ্জে এমন অনেক লোকায়ত সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, ক্রমবিলুপ্তির পথে আজ যারা প্রায় ইতিহাস। 'ছোকরা নাচ' তার অন্যতম উদাহরণ। বিগত দুই দশকে গ্রামবাংলার উৎসবের অন্যতম অংশ হয়ে থাকত 'ছোকরা নাচে'র আসর। স্বাধীনতার সময়েও দুই বাংলা মিলিয়ে এই পেশায় যুক্ত ছিলেন অন্তত চল্লিশ হাজার মানুষ। আজ সেই সংখ্যাটা ৫০০র বেশি নয়। বাংলার লোক-সংস্কৃতিকে বাঁচাতে অনেক সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নিয়েও এই নাচের সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।
গ্রামবাংলার অনেক প্রাচীন লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যে ঐতিহ্যপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক চেতনার প্রভাব দেখা যায়। 'ছোকরা নাচে'র মধ্যে অবশ্য এসব কিছু নেই। বয়সের দিক থেকেও এই নাচ খুব পুরনো নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি রংপুর অঞ্চলে এ-ধরণের নাচের প্রচলন শুরু হয়। বিশ শতকের শুরুতেই রাজশাহী, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে ছোকরা নাচ। রংপুরে এই নাচ 'বেনাকুশাইন' নামে পরিচিত। রাজশাহী-মুর্শিদাবাদে এর নাম 'আলকাপ'। কর্মক্লান্ত কৃষক-মজুররা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ডুবে যায় চটুল রঙ্গ-রসিকতার মধ্যে। তারপর সারারাত ধরে চলে নাচগানের আসর। অনেক সময়ই তা শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে যায়।
'ছোকরা' বলতে নারীবেশী এক যুবক পুরুষ। নাচের সাজসজ্জায় তার মধ্যে যুবতী নারীর আবেদন থাকে স্পষ্ট। মঞ্চে গোল হয়ে বসে গানের পরিবেশন করা হয়। গানের বিষয়বস্তু মূলত লৌকিক প্রেম। তার সাথে রাধা-কৃষ্ণের কাহিনিও যুক্ত হয়। গানের প্রধানকে গীদাল ও সহকারীদের দোহার বলা হয়। মঞ্চের একপাশে বসে গীদাল গান করে আর তাকে বাজনায় সঙ্গত করে দোহাররা। বাজনা বলতে বেনা, জুড়ি, হারমোনিয়াম, ঢোল, বাঁশি। দুই বা তার বেশি অভিনেতা দর্শকদের সামনে গানের কথা ফুটিয়ে তোলে। অভিনেতাদের একজন পুরুষের ভূমিকায় অভিনয় করে। বাকিরা যুবতী সাজে। নাচের মূল আকর্ষণ এই যুবতীবেশী পুরুষরা। এদেরকেই ছোকরা বলা হয়। দৈহিক প্রেমের অভিনয়ে ছোকরাদের অশ্লীল দেহভঙ্গি শিক্ষিত শহুরে মানুষের রুচিশীলতায় আঘাত করে। ছোকরারা তাদের অশ্লীল দেহভঙ্গি দিয়ে যখন দর্শকদের মন মাতিয়ে তোলে, তখন অনেক সময় বাইজি নাচের মতো দর্শকদের কাছে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করতেও দেখা যায়। অনেক সময় দুই দলের ছোকরাদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে। গ্রাম্য এই সংস্কৃতিকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমান যৌথ বিনোদনের এক অভাবনীয় দৃশ্য ফুটে ওঠে।
তবে ক্রমশ বিলুপ্তির হাত থেকে এই সংস্কৃতিকে বাঁচাতে অনেকেই উদ্যোগ নিতে চান। কিন্তু যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি থেকে 'ছোকরা নাচে'র জন্ম, সেই পরিস্থিতিই তো আজ আর নেই। মানুষের সস্তা বিনোদনের সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছে টিভি চ্যানেলগুলি। বিশ্বায়িত সংস্কৃতির চাপে হারিয়ে যাচ্ছে অনেককিছুই। একদিন হয়তো 'ছোকরা নাচ'কে খুঁজে পাওয়া যাবে কেবল ইতিহাসের পাতায়। অবশ্য সে রাস্তাও খুব একটা সহজ নয়। গ্রামগঞ্জের সহজ বিনোদনের সাথে জড়িয়ে থাকা এই নাচকে শিক্ষিত বাঙালি মূলত অশ্লীল সংজ্ঞা দিয়ে দূরে সরিয়েই রেখেছে। তার মধ্যে রূপ ও রসের বৈচিত্র্যকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন অনেকেই।
সূত্র - বাংলার লোক-সংস্কৃতি, ডক্টর ওয়াকিল আহমদ
বাংলার লোকনাট্য : যৌথ সংস্কৃতি ও সজীব সামর্থ্য, তুষার চট্টোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor