কুড়ি রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ, বাংলার ‘ডব্লিউ জি গ্রেস’ বলা হত উপেন্দ্রকিশোরের দাদাকে

শুরুটা হোক দুরন্ত একটা ছেলের গল্প দিয়ে।

ছেলেটা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছিল কিন্তু ম্যালেরিয়ার জন্য পরীক্ষায় বসা হয়ে ওঠেনি। অগত্যা জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ভর্তি হয়ে এফ.এ আর বি.এ পাশ। ছেলেটা অত্যন্ত বিত্তশালী নামী পরিবারের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই তার চেহারাটা চোখে পড়বার মতো! অম্বু গুহের আখড়ায় ব্যায়াম করে দুর্দান্ত চেহারা বানিয়েছিল! নিয়মিত কুস্তি করত। লাঠিখেলা, ফেনসিং এসবেও একেবারে চৌখস ছিল। একটা শো-তে বক্সিং চ্যাম্পিয়ন হয়ে রুপোর প্রজাপতিও প্রাইজ পেয়েছিল। আর হ্যাঁ! ক্রিকেট ও মারাত্মক খেলত ছেলেটা।

সাহেবরা তখন এই অগোছালো কলকাতা শহরে 'ন্যাশনাল টাইমপাস' হিসেবে বেশ জমিয়ে ক্রিকেট খেলছেন। বাঙালিরাও তখন টেক্কা দেওয়ার জন্য ইতিউতি টাউন ক্লাব বানিয়ে ফেলল। হেমবাবু নামক জনৈক কেউকেটা বলিষ্ঠ ক'জন বাঙালি যুবককে নিয়ে ক্রিকেট দল তৈরি করে জোরকদমে অনুশীলন শুরু করে দিলেন। আমাদের বলিষ্ঠ ছেলেটিও হেমবাবুর চোখ টানল। তিনি তাকে ক্রিকেট খেলবে কিনা জিগ্যেস করলে সে বলল, 'সুযোগ পেলে চেষ্টা করে দেখতে পারি!' হেমবাবু বুঝলেন ছেলেটার যা চেহারা, তাতে সে খুব ভালো বোলার হতে পারবে। তিনি বললেন, ‘মনটাকে ঠিক রাখবে, দেখবে হাতের থেকে বল আপনিই লক্ষ্যে গিয়ে আছড়ে পড়বে!' হেমবাবুর এমত দার্শনিক কথাবার্তা দর্শনের এই ছাত্রের মন কাড়ল। ...সে রীতিমতো অনুশীলন শুরু করল। তারপর তাকে দেখা গেল বোলার হিসেবে নামী এক ইউরোপিয়ান ক্লাবের বিরুদ্ধে কলকাতা টাউন ক্লাবের হয়ে নামতে। তারপর? খেলা শুরুর কিছু সময়ের মধ্যেই ছেলেটার হাতে সাত উইকেট, কুড়ি রানের বিনিময়ে! ছেলেটার নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পরবর্তীকালে সারা বিশ্ব যাকে চিনবে ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ নামে।

সাহেবদের একজন ডব্লিউ.জি.গ্রেস থাকলেও আমাদের বাঙালিও পেয়েছিল এক ক্রিকেটীয় ঠাকুর্দাকে। বাংলার 'ডব্লিউ জি গ্রেস'ও বলা হত তাঁকে কখনও-সখনও। তিনি সারদারঞ্জন।
 কিশোরগঞ্জের মশুয়া গ্রামে খেললেন ক্রিকেট। সেটাই হয়ে গেল ইতিহাস। তিনিই বাংলায় ক্রিকেট খেলার জনক। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর তিনি বড় ভাই।

জন্ম কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর মশুয়া গ্রামে, বিখ্যাত রায় পরিবারে। এক হাতে বই, আরেকটায় ব্যাট - সারদারঞ্জন রায়ের পরিচিত ব্যক্তিরা এভাবেই তাঁর পরিচয় দিতেন। কবে যে কার কাছে ক্রিকেট শিখেছিলেন, তা আর কেউ বলতে পারে না। তবে বাংলায় ক্রিকেট খেলার প্রচলন তিনিই করেছিলেন।

সেসময় ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। সারদারঞ্জনরা ছিলেন পাঁচ ভাই - সারদারঞ্জন, উপেন্দ্রকিশোর, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন আর প্রমদারঞ্জন মিলে গড়েছিলেন ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব। পরে টাউন ক্লাবও গড়েন কলকাতায়। দু'দলেরই ক্যাপ্টেন সারদারঞ্জন। দু'দলই নিয়মিত সাহেবদের দলের বিরুদ্ধে খেলত। বাংলায় জেলাভিত্তিক ক্রিকেট দল গড়ে তাঁরা টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে থাকেন। ক্রিকেটের নিয়মকানুন নিয়ে প্রথম বাংলায় লেখা বই লেখেন এই সারদারঞ্জনই।

সারদারঞ্জন লিখেছেন, ‘ঢাকার কলেজের সাহেব প্রফেসরগণ এ বিষয়ে (ক্রিকেট) খুব উৎসাহী হইয়া ছেলেদের শিক্ষা দিতেন। এখনো বাঙ্গালী ছেলেদের মধ্যে যাঁহারা এ খেলার প্রশংসা লাভ করিয়াছেন, তাহাদের অধিকাংশ ঢাকার। ১১ বছর হইল পূর্ববঙ্গের ছেলেরাই প্রথম কলিকাতা শহরে প্রেসিডেন্সি কলেজে ক্লাব খুলিয়া খেলা আরম্ভ করেন।’

১৮৮৪ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি ক্লাবের সঙ্গে এক খেলায় ঢাকা কলেজ জয়লাভ করে। নেতৃত্বে ছিলেন সারদারঞ্জন রায়। ছাত্র হিসেবেও ছিলেন তুখোড়। বিএ পরীক্ষায় ঢাকা অঞ্চলে প্রথম।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। আলীগড়ের ছাত্রদেরও তিনি ক্রিকেটে হাতেখড়ি দেন। পরে অধ্যাপক হিসেবে ফেরেন নিজের ঢাকা কলেজে। পাশাপাশি চলতে থাকে ক্রিকেটও।
তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে খেলতে ঢাকা কলেজের একটি দল কলকাতা যায়। ছাত্র-শিক্ষক মেশানো সেই দলে ছিলেন তিন ভাই সারদা, কুলদা ও প্রমদা। প্রথম খেলায় প্রেসিডেন্সি হেরে গেলে এর ছাত্ররা দল থেকে শিক্ষকদের বাদ দেওয়ার দাবি তোলেন। সারদা এতে জোরালো আপত্তি করেন। কিন্তু কলেজের ব্রিটিশ অধ্যক্ষ বুথ ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাবের ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধে রাজি হয়ে যান। এ নিয়ে সারদারঞ্জনের সঙ্গে তাঁর মনোমালিন্য হয়। ঢাকা কলেজ থেকে পদত্যাগ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুরোধে তিনি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে যোগ দেন।

সেখানে অর্থসংকট থাকায় গোড়াতেই তাঁর বেতন অনিয়মিত হয়ে যায়। তখন এস রায় অ্যান্ড কোম্পানি নামে তিনি বই আর ক্রিকেট পণ্য বিক্রি শুরু করেন। কলকাতায় ১৮৯৫ সালে শুরু করেন বাংলার প্রথম ক্রিকেটসামগ্রীর দোকান। তখন বিলেতি ব্যাট ও বল পাওয়া যেত কেবল তাঁর দোকানেই। শিয়ালকোট থেকে আনা উইলো কাঠে শিক্ষার্থীদের জন্য সস্তায় ব্যাট বানানো শুরু হয় তাঁর যশোর রোডের কারখানায়।

ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটে বিজয়চন্দ্র সর্বাধিকারীর আগ্রহ ছিল। গায়ের রং কালো বলে সহপাঠীদের দেওয়া বেরী নামেই বেশি পরিচিত হন। নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী ছিলেন তাঁর দাদা। গ্র্যাজুয়েশনের পর কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজের ক্রিকেট টিমে খেলতে থাকেন তিনি। স্পোর্টিং ইউনিয়ন আর কালীঘাট ক্লাবে দাপিয়ে খেলতেন। তাঁর জীবনের সর্বোচ্চ কৃতিত্ব 'ইউনিভার্সিটি অকেশনাল' নামে ক্রিকেট সংস্থা গঠন। ভারত তথা বাংলার সেরা ক্রিকেটাররা এই ক্লাবে খেলেছেন- সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্তিক বসু প্রমুখ।

স্বাধীন ভারতে প্রথম বাঙালি টেস্ট ক্রিকেটার সুধাংশু শেখর বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি মন্টু নামে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন।
বাংলার কিংবদন্তি পেসারের জন্ম শতবর্ষ এই ২০১৯ সালেই। ১৯৪৮ সালে একটা মাত্র টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। ওয়ালকট, উইকসদের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই একমাত্র টেস্টে দু'ইনিংস মিলিয়ে ঝুলিতে পাঁচ উইকেট।

যার পুরস্কার, পরের টেস্টেই বাদ! অনেকের মতে ময়দানি রাজনীতির শিকার। গ্র্যান্ড হোটেলে দু'দেশের ক্রিকেটারদের ডিনার পার্টিতে জানা যায়, পরের মুম্বই টেস্ট থেকে বাদ মন্টু। মুম্বই টেস্টে অভিষেক হয় সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তাঁরও আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শুরু ও শেষ ওই মুম্বই টেস্টেই। যাই হোক, গ্র্যান্ডের পার্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটাররা রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিন, মন্টুর বাদ যাওয়ার খবরে। তাঁরা বলেছিলেন, 'তুমি ইন্ডিয়ান, আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান। পরের টেস্টটা আমাদের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে খেলো।'

আর কখনো জাতীয় টিমে শিকে ছেঁড়েনি, কিন্তু পেয়েছিলেন জীবনের এক পরম বন্ধুকে। বিশ্ব ক্রিকেট যাঁকে চেনে ফ্র্যাঙ্ক ওরেল নামে। সেই ওরেলের আমন্ত্রণে সেন্ট্রাল ল্যাঙ্কাশায়ার লিগে রয়টন ক্লাবের হয়ে পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে ছ'মাস খেলে এসেছিলেন। এর সঙ্গে মিশে যায় এক দুঃখের গল্পও!

মন্টু নিজের মাকে কথা দেন, এক বারের বেশি আর বিদেশ যাবেন না। তাই যে দিন জাহাজে চেপে বাড়িতে ফেরেন, সে দিনই মন্টুর পাসপোর্ট জ্বলন্ত উনুনে ফেলে দেন তাঁর মা। অভিমানেই হোক বা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাতেই হোক, আর কখনো পাসপোর্টের জন্য আবেদনই করেননি মন্টু।

'৩৬ আর '৪৬-এ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে আর পরে দুটো ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন সুঁটে বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম সফরে নির্বাচিত হওয়ার সময় প্রতিদ্বন্দ্বী মিডিয়াম পেসার ত্রয়ী ছিলেন মহম্মদ নিসার, অমর সিংহ আর জাহাঙ্গির খান। এই রকম মারাত্মক পেস বোলার ত্রয়ী ভারতীয় ক্রিকেটে নাকি আর আসেনি। তবু সেই বঙ্গসন্তান এই বাংলা থেকে লড়েই দলে জায়গা করেছিলেন। পরের সফর ১৯৪৬, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউ ছিলেন না। ওই সফরেই ওভালে শেষ উইকেটে চাঁদু সারওয়াতের সঙ্গে ২৪৯ রান যোগ করেছিলেন। বিপক্ষ ছিল সারে। সাড়া পড়ে গিয়েছিল সুঁটে-সারওয়াতের সেই জোড়া সেঞ্চুরিতে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আজও শেষ উইকেটে ওটাই দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টনারশিপ। সুঁটেকে তবু খেলানো হয়নি সেই সফরে। এরপর ১৯৪৯-এ আচমকাই টেস্ট ক্রিকেটের দরজা খুলে যায় সুঁটের কাছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একটাই টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন ব্রেবোর্নে। পাঁচ উইকেট নেন। শেষ ওভারে অপরাজিত অবস্থায় একটা ছক্কাও মেরেছিলেন। কিন্তু আর টেস্ট ম্যাচ পাননি। জীবনের প্রথম টেস্টে পাঁচ উইকেট নিয়েও আর ম্যাচে সুযোগ না পাওয়া, এমন হতভাগ্যের সন্ধান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি পার্কে এক রকম নিজে নিজেই খেলা শিখে কিংবদন্তি হয়েছিলেন আরেক বাঙালি ওপেনিং ব্যাটসম্যান।
তিনি পঙ্কজলাল রায়। বিনা হেলমেটে চশমা চোখে বাইশ গজে দাঁড়াতেন তিনি।
১৯৫১ সালে ভারতের হয়ে দিল্লিতে সফরকারী ইংল্যান্ড দলের বিপক্ষে অভিষেক। সেই ইনিংসে মাত্র ১২ রান করলেও ঐ সিরিজে তিনি দুটো সেঞ্চুরি করেছিলেন।
পঞ্চাশের দশকেই ৪৩ টেস্টে ভারতের ইনিংস ওপেন করে ২৪৪২ রান, তাঁর টেস্টে প্রথম উইকেটে ৪১৩ রানের বিশ্বরেকর্ড (বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে) অর্ধশতাব্দীরও বেশি অক্ষত ছিল।

ভারতীয় ক্রিকেট আজ অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু কলকাতার এই বাঙালি ক্রিকেটাররা ডুবে গেছেন বিস্মৃতির অতলে!