সিকিমের 'গর্ব' তীর-ধনুককে বাঁচিয়ে রাখতে লড়াই বৃদ্ধের

কুস্তি কিংবা বক্সিং-এর ক্ষেত্রে যেমন অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেকটাই এগিয়ে থাকে হরিয়ানা, তেমনই তীরন্দাজিতে এক-সময় ভারতের মধ্যে প্রথম দিকেই থাকত সিকিম (Sikkim)। এমনকি দেশের একমাত্র তীরন্দাজ হিসাবে ৩টি অলিম্পিকে অংশ নেওয়া তরুণদীপ রাই-এর বাড়িও এই রাজ্যেই। তার কারণটাও খুব স্পষ্ট। কারণ, ১৯৭৫ সালে ভারতে সংযুক্ত হওয়ার আগে পৃথক দেশ ছিল সিকিম। আর সে-দেশের জাতীয় খেলা ছিল তীরন্দাজি। তীরন্দাজি সিকিমের ঐতিহ্যও বটে। তবে বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে বিদেশি তীর-ধনুকের দাপটে অবলুপ্তির পথে সিকিমের ঐতিহ্যবাহী বাঁশের ধনুক (Bamboo Bow)।

শেরিং দর্জি ভুটিয়া (Tshering Dorjee Bhutia)। বিগত সাড়ে ছ’দশক ধরে সিকিমের ঐতিহ্যবাহী কাঠের ধনুক তৈরি করে যাচ্ছেন ৮৩ বছর বয়সি বৃদ্ধ শিল্পী। মূলত, বাঁশ এবং কাঠ দিয়েই তৈরি হয় এই ধনুক। তার ওপরে লাগানো হয় ছাগল বা ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ। শুধু খেলাই নয়, সিকিমের সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে এই তীর-ধনুক। যা একসময় ছিল সিকিম দেশের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্রও। 

আশির দশক এমনকি বিশ শতকের শেষলগ্নেও রমরমিয়ে চলত কাঠের তৈরি এই ধনুকের ব্যবসা। গোটা সিকিমজুড়েই ধনুক ও তীর সরবরাহ করত প্যাকিয়ং-এর নির্মাতারা। হ্যাঁ, এই গ্রামেই বসবাস ৮৩ বছর বয়সি শেরিং-এর। তবে বলতে গেলে, আজ প্রায় নিঃসঙ্গ তিনি। একটা সময় প্যাকিয়ং-এ সবমিলিয়ে প্রায় ১৫-২০টি ওয়ার্কশপ ছিল ধনুকশিল্পীদের। আজ সেই সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ জনে। শেরিং একই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ করে চলেছেন অক্লান্তভাবে। 

মজার বিষয় হল, সিকিমের বহু জাতীয় স্তর খেলা তীরন্দাজই খেলা শিখেছেন শেরিং-এর বানানো ধনুকে। সেই তালিকায় রয়েছেন তরুণদীপও। তবে ক্রমশ বিদেশি প্রযুক্তিতে ছেয়ে যায় সিকিমের বাজার। শেরিং নিজেও জানেন, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর এই ধনুক দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বা অলিম্পিক খেলা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার নিয়মাবলীও পাল্টেছে বিস্তর। ফলে, এক-কথায় হার স্বীকার করেই নিয়েছেন তিনি। তবে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই ধরে রেখেছেন এই শিল্পকে।

আরও পড়ুন
দুই অখ্যাত আফ্রিকান শিল্পীই অনুপ্রেরণা পিটার ব্রুকের

লাসুম, সোনাম লোচার, সাগা দাওয়া— প্রাচীন কাল থেকেই এইসব স্থানীয় উৎসবগুলিতে ব্যাপকভাবে তীরন্দাজি প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়ে আসছে সিকিম। আর এইসব উৎসবের দৌলতেই বছর সামান্য কিছু বিক্রিবাটা হয় শেরিং-এর। তবে সেটাতেও কোপ বসিয়েছে করোনা মহামারী। সেইসঙ্গে জাপানের ফাইভারের তৈরি সস্তা ধনুকও কোণঠাসা করে তুলেছে তাঁকে। 

আরও পড়ুন
পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে চিত্রকর্ম! পথ দেখাচ্ছেন দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্পী

বর্তমানে গোটা বছরে বিক্রি হয় মাত্র ৪-৫টি ধনুক। যেখানে ৭৫০ টাকার একটি ধনুক তৈরিতেই তাঁর খরচ হয়ে যায় প্রায় ৬০০ টাকা। এই টাকায় যে সংসার চলে না, তা বলাই বাহুল্য। তাই পেট চালাতে কাঠের আসবাব-পত্র, দরজা-জানলা সারানোর কাজ করেন শেরিং। তবে ধনুক শিল্পের এই দুরাবস্থার কারণে, মুখ ফিরিয়েছেন তাঁর তিন সন্তানই। অন্যদিকে ক্রমশ বয়স বাড়ছে শেরিং-এরও। কতদিন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন তিনি— শেষ বয়সে সেই চিন্তাই যেন কুরে কুরে খাচ্ছে অশীতিপর শিল্পীকে…

Powered by Froala Editor