জীবনের শেষে এসে হাসপাতালে দান করলেন ডায়ালিসিস মেশিন, ইচ্ছাপূরণ ক্যান্সার আক্রান্ত বৃদ্ধের

বরানগরের বৃদ্ধ মানুষটি পৌঁছে গিয়েছেন জীবন সায়াহ্নে। তার উপর ক্যান্সার থাবা বসিয়েছে শরীরে। আর বেশিদিন বাঁচবেন না, সেকথা তিনি নিজেও জানেন। অথচ এখনও রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে ঘুরে বেড়ান এক অফিস থেকে আরেক অফিসে। বয়সের ভারে হোঁচট খান, পড়েও যান মাঝে মাঝে। আবার উঠে দাঁড়ান। লড়াই ছাড়তে পারেননি এখনও। উপযুক্ত স্বাস্থ্যপরিষেবার অভাবে প্রতিদিন কত রোগীকে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয় সেই দৃশ্য তিনি নিজেই দেখেছেন। তাই তিনি চান সরকারি হাসপাতালগুলিতে স্বাস্থ্যপরিষেবা হয়ে উঠুক আরও উন্নত এবং পরিচ্ছন্ন।

আরও পড়ুন
তাঁর বই স্টলে রাখুক কেউ, অনুরোধ নিয়ে বইমেলায় ঘুরছেন বৃদ্ধ বাঙালি বিজ্ঞানী

মধুসূদন শিকদার, বয়স ৮৮। নিজের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে দিয়েছিলেন আর জি কর হাসপাতালের জন্য ডায়ালিসিস মেশিন কিনতে। দাম দশ লক্ষ টাকারও বেশি। এই মেশিন কিনতে তিনি দিয়ে দিয়েছেন নিজের কিষান ক্রেডিটকার্ড এবং স্ত্রীর গ্র্যাচুইটির সমস্ত জমা অর্থ। অনেকেই বলেছিলেন নিজের জন্য কিছুটা রাখতে। কিন্তু সেকথা কানে তোলেননি মধুসূদনবাবু। শুধু একটিই শর্ত রেখেছিলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে। ডায়ালিসিসের জন্য ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে বসাতে হবে বিশুদ্ধ জলের আর.ও. প্ল্যান্ট। নিজের শেষ সম্বল দিয়ে কেনা মেশিন পড়ে পড়ে নষ্ট হবে, এমনটা তিনি ঘটতে দেবেন না। রোগীদের ডায়ালিসিস করতে হবে আর.ও. প্ল্যান্টের বিশুদ্ধ জলেই। আর সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কোথায় না গেছেন! চিঠি লিখেছেন হাসপাতালের স্বাস্থ্য অধিকর্তা থেকে মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যেককেই।

আরও পড়ুন
লাগিয়েছেন ১ লক্ষেরও বেশি গাছ, পদ্মশ্রী আদিবাসী বৃদ্ধার

বরানগরের এই বৃদ্ধের মানসিক জোরে অবশেষে কাজ হল। মাত্র দুমাসের মধ্যে তড়িঘড়ি বসানো হল বিশুদ্ধ জলের প্ল্যান্ট। আর তাও চারতলার ডায়ালিসিস ইউনিট থেকে আটতলার ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট পর্যন্ত। পরিশুদ্ধ জলের অভাবে প্রায় দেড় বছর গুদামে পড়ে ছিল এই মেশিন। অবশেষে মধুসূদনবাবুর ইচ্ছা পূরণ করতে পেরে খুশি স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডাঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট নেফ্রোলজিস্ট ডাঃ রাজেন পাণ্ডে এবং আর জি করের অধ্যক্ষ ডাঃ শুদ্ধধন বটব্যাল প্রত্যেকেই। তাঁর এই ‘বিচিত্র’ ইচ্ছা দেখে মুগ্ধ সকলেই। এদিকে তাঁর শর্ত পূরণ হতে দেখে আপ্লুত মধুসূদনবাবুও। ১২ মার্চ বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের হাতে মেশিন তুলে দেন তিনি। আর সেই মুহূর্তে তাঁর চোখেও জল এসে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন
গরিব শিশুদের খেলনা উপহার ৮০ বছরের বৃদ্ধের, বড়দিনের ‘সান্টাক্লজ’ তিনিই

আর জি কর হাসপাতালে মধুসূদনবাবু ও তাঁর স্ত্রী শিবানী এর আগেও অনেক মূল্যবান যন্ত্র দান করেছেন। ২০১৮ সালে যখন তাঁর বয়স ৮৬ বছর, তখন থেকেই তাঁর যোগাযোগ এই হাসপাতালের সঙ্গে। চক্ষু বিভাগের জন্য তিনি দিয়েছেন স্লিট ল্যাম্প, অপথ্যালমোস্কোপ। আর এবার দিলেন ডায়ালিসিস মেশিনের মতো দামি এবং প্রয়োজনীয় মেশিন। বেসরকারি হাসপাতালে তো দামি দামি সরঞ্জাম এসে যায় নিমেষে। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে অনেকসময়ই সরকারি হাসপাতাল থেকে ফিরে যান রোগী। আর বেসরকারি হাসপাতালের বহুমূল্য চিকিৎসার সুযোগই বা কতজন পেতে পারেন? মধুসূদনবাবুর এই প্রয়াস সেইসব হতদরিদ্র মানুষদের নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। জীবনের শেষে এসে এর থেকে পরিতৃপ্তির বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না।

Latest News See More