১৯১৯। জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী যে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের আঁচ এসে পড়ল কলকাতাতেও। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাইটহুড উপাধি ত্যাগ করলেন। আর সেইসঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে শুরু হয়ে গিয়েছে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। রাজনীতির আঙিনায় কিন্তু এবার তরুণদেরই ভিড় বেশি। তাছাড়া সদ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। ফলে অনেকেই কাজ খুইয়ে বেকার হয়ে বসে আছে। আর এই সবটা মিলিয়েই কলকাতার রাজনীতির চরিত্রটা একটু একটু করে বদলাচ্ছিল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল হরতাল, ধর্মঘট এবং পিকেটিং। এইসবের মধ্যে রোজকার পরিবহন ব্যবস্থা তো সমস্যার মুখে পড়ছেই। তার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শুরু হল ট্রাম ধর্মঘট। ফলে সবচেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়লেন সরকারি অফিসের কর্মচারীরা। আর তাঁদের সেই সমস্যার সুরাহা করতে এগিয়ে এলেন একদল অধঃস্তন যুবক।
সরকারি অফিসের মাল বয়ে নিয়ে যাওয়ার বিশেষ লরিগুলোয় কাঠের বেঞ্চি লাগিয়ে শুরু হল যাত্রী পরিবহনের নতুন বন্দোবস্ত। আর তাতে চড়েই দিব্যি রোজ অফিসে পৌঁছে যেতে লাগলেন বাবুরা। ট্রাম শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছে তো কী হয়েছে? বাস তো আছে। বাসের নির্দিষ্ট স্টপে বাবুরা দাঁড়িয়ে থাকেন, আর হর্ন দিয়ে বাস থামলেই লাফিয়ে উঠে পড়েন কাঠের পাটাতনের উপর। তবে গাড়িগুলো মূলত মাল পরিবহনের লরি হিসেবেই ব্যবহার করা হত, ফলে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য রীতিমতো উঁচু ছিল। অনেক সময় এমনও দেখা যেত, বেশ নাদুসনুদুস মধ্যবয়স্ক এক লোক বাসে ওঠার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন, আর তাঁর দুহাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করছে দুই যুবক। এমন দৃশ্য যতই হাস্যরসের উদ্রেক করুক না কেন, শহরবাসীর জীবনে বাস যেন এক মসীহা। মাল পরিবহণের জন্য যাঁদের লরির ব্যাবসা ছিল, তাঁরা ব্যবসা ছেড়ে দিলেন। বাসের জন্য ছাপা হল টিকিট। যাত্রী ওঠা-নামার জন্য মইয়ের ব্যবস্থা করা হল। এমনকি অনুমতি নেওয়া হল খোদ পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে।
তবে কলকাতার রাস্তায় বাস কিন্তু তার আগেও চলেছে। অবশ্য সে বাস ছিল ঘোড়ায় টানা। ১৮৩০ সালে ধর্মতলা থেকে ব্যারাকপুর অবধি যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। আর তিনটে ঘোড়ার টানে যাত্রীবোঝাই গাড়ি এগিয়ে যেত। কিন্তু কী জানি কেন, সেই বন্দোবস্ত বেশিদিন চলল না। আর এমনিতেও কলকাতার রাস্তাঘাট তখন বদলাচ্ছে। ইঁট ভাঙা খোয়াইয়ের বদলে শুরু হয়েছে পাথরের খোয়াইয়ের ব্যবহার। ফলে ঘোড়ায় টানা গাড়িও হারিয়ে যাচ্ছে। তবে মোটর গাড়ি মূলত ধনবান ব্যক্তিদের জন্যই ছিল। আর সাধারণ মানুষদের জন্য ছিল ট্রাম। কিন্তু ট্রাম কর্মচারীদের ধর্মঘটই পুরো ব্যবস্থাটাকে বদলে দেয়। কলকাতার বাস জনপ্রিয় হয়ে উঠল অচিরেই। দেখতে দেখতে বাড়তে লাগল তার জৌলুস। যেমন রঙের বাহার, তেমনই নামের বাহার। কারোর নাম 'মেনকা', কারোর 'উর্বশী', কারোর আবার 'পথের বন্ধু' বা 'চলে এসো'। ব্যবসা থেকে মুনাফাও আসতে লাগল প্রচুর। আর তাই বিদেশি কোম্পানিগুলোও আর দেরি করতে চাইল না। বাজারে এসে গেল ওয়ালফোর্ড কোম্পানি। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের পূর্বদিকে লালবাজারের একটু আগে তৈরি হল ডিপো। কলকাতায় এল তাদের বিরাট বিরাট লাল রঙের বাস। আর এই বাসের আরেকটা গুণ হল, এগুলো দোতলা।
১৯২৬ সালে দোতলা বাস নামল কলকাতায়। আর তার ছাদগুলোও প্রথমে খোলা থাকত। অহীন্দ্র চৌধুরীর লেখায় তার সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। "বৃষ্টিতে সব ছাতা মাথায় বসে আছে দোতলায়, আর বাস চলছে। গ্রীষ্মের সময় প্রচুর হওয়া। লোকে হাওয়া খেতে বাসে উঠত। কালীঘাট থেকে এক বাসে শ্যামবাজার গিয়ে, আবার ঐ বাসেই কালীঘাটে ফিরে আসা, এ তখন ছিল বহু লোকের শখ।" এমনকি কলকাতা ঘুরতে এলেও গ্রাম মফঃস্বলের মানুষরা একবার বাসে চড়তে ভুলতেন না। অবশ্য কলকাতার বাইরেও বাস পরিষেবা চালু হতে খুব দেরি হয়নি। এ. সোভান নামে এক স্থানীয় ব্যবসাদারের উদ্যোগে প্রথম কলকাতা থেকে মফঃস্বল বাস চালু হয়। আর তারপর ১৯২৬ সালে ওয়ালফোর্ড কোম্পানি যখন আসে, তারা তো বেশ গুছিয়েই বসেছিল। প্রথম দুবছর বাসের সংখ্যা ছিল ৫০-এর আশেপাশে। তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে বাসের সংখ্যা। জনপ্রিয়তারও কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর আসে সরকারি বাস। কিছুদিনের মধ্যেই বেঁধে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট ভাড়া। শহরের রাস্তায় বাসের গতি আটকাতে পারেনি আর কেউই। শুধু রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী হাত দেখালেই 'বাঁধবে' বলে দাঁড়িয়ে পরে। তারপর আবার চলতে শুরু করে।
শহরে প্রথম বাস চলাচল কত সালে শুরু হয়েছিল, কেউ বলতে পারে না। তবে প্রায় ১০০ বছর তো পেরোতে চলল। এর মধ্যে মেট্রো রেল এসেছে। তাছাড়া বাস চলাচলের ফলে যানজটও বাড়ছে। আবার পরিবেশ দূষণের পরিমাণও বাড়ছে। এখন অবশ্য আধুনিক সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহারে দূষণ নিয়ন্ত্রণে আসছে। তবে যাই হোক, বাস এমন একটা গাড়ি যাকে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই পেয়ে যাবেন। আর কোনো যাত্রীই বোধহয় বাসের কাছ থেকে ফিরে যায় না। জায়গা নেই তো কী হয়েছে? পিছন দিকে এগিয়ে যান, সব খালি!
তথ্যসূত্র: কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র
Powered by Froala Editor