পুরনো বইয়ের বাজার। শুনলেই কেমন কৌতূহল জাগে না? আপনি যদি বইপ্রেমী হন, এইসব পুরনো বইয়ের ঠিকানা আপনার জানা থাকবেই। সুযোগ পেয়ে ঢুঁ দিলেই হল। নতুন বইয়ের তুলনায় অনেক কম দামে পাওয়া যায় বেশিরভাগ বই। কখনও পেয়ে যেতে পারেন দুষ্প্রাপ্য বইও, যা হয়তো আশাও করেননি কোনোদিন। সেই হঠাৎ-প্রাপ্তির স্বর্গ আপনাকে দিতে পারে কলকাতার এসব পুরনো বইয়ের দোকানই। ঢুঁ মারা যাক তেমনই এক জায়গায়।
মেডিকেল কলেজ আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যিখান দিয়ে যে রাস্তাটা চলে গেছে, সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে বহুবছর ধরে বসে পুরনো বইয়ের বাজার। দোকানিরা ক্রেতার মন বুঝে এগিয়ে দিচ্ছেন বই। কত ক্রেতা ধৈর্য ধরে পাতা উল্টে বুঝতে চাইছেন বইটি কেমন। কেউ বা দুষ্প্রাপ্য বই পাবার আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরছেন। পুরনো বই কেনার মতো বিক্রি করাও এক নেশা। শুধুমাত্র বই ভালোবেসে, ক্রেতার হাতে বই তুলে দেওয়ার নেশায় ছাব্বিশ বছর ধরে এই চত্বরে কাজ করছেন দীপঙ্কর দত্ত।
আরও পড়ুন
গত শতকের বিখ্যাত এই বাংলা প্রকাশনা সংস্থাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কেন?
লাভ কেমন? উত্তরে দীপঙ্করবাবু বলেন, অনলাইন বইয়ের বিক্রির জন্য কিছুটা মার খেলেও, পুরনো বইয়ের মূল্য যারা বোঝেন তাঁরা ঠিকই আসেন। তাঁর মতে, অনলাইনের বই কেনার ক্ষেত্রে বইটির কনটেন্ট আগে থেকে জানা থাকে না। মোটামুটি সেই বইটি সম্বন্ধে আন্দাজ না থাকলে পরে অসুবিধে হতে পারে। এছাড়া বই বদলানোর প্রয়োজনে যে টেকনোলজির ঝামেলা, তা পোহাতে হয় না এক্ষেত্রে। নিজের হাতে বইয়ের পাতা উল্টে দেখে নেওয়া যায়, কেনা যাবে কিনা। তার ওপর আবার অনেক বইয়ের দামই থাকে চড়া। ছাত্রছাত্রী, বইপ্রেমীরা সব বই কিনে উঠতে পারেন না। পুরনো বই হলে দাম সামর্থ্যে থাকে। তখন সে চাহিদা পূরণ হয়।
তবে বিচিত্র অনেক অভিজ্ঞতাও আছে দীপঙ্করবাবুর। ধরা যাক, কোনো পুরনো বইয়ের দাম ছাপা তিনটাকা। সেই তিনটাকা এখনকার হিসেবে অনেক। অনেক ক্রেতাই ওই লেখা দামের থেকে বেশি কেন নেওয়া হচ্ছে বলে প্রশ্ন তোলেন। তাঁরা বোঝেন না, পুরনো বইয়ের দাম তার অ্যান্টিক মূল্য অথবা সেটা যোগাড় করার উপর নির্ভর করে। চুরিও হয় বই। রুচিসম্মত শিক্ষিত মানুষ কুড়ি, পঞ্চাশ টাকার বই হাতসাফাই করছেন। আবার সত্যিই কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা মূল্য নিয়ে একটি প্রশ্নও তোলেন না। বর্ধমানের রাজার লেখা মহাভারত, তাতে তখনকার পুরনো কাঠের ব্লকে ছাপা ছবি আছে, যা এখন দুর্লভ। এক ক্রেতা দু’হাজার টাকা দিয়ে সেই বইটি কিনে নিয়ে যান। একবারও জিজ্ঞাসা করেননি কেন বইটির এই দাম রেখেছেন দীপঙ্করবাবু।
পুরনো হোক কিংবা নতুন - টিনটিন, অ্যাসটেরিক্স, টারজানের সবসময় হিট। অথবা সন্দেশ, শুকতারা, আনন্দমেলার সবথেকে পুরনো প্রথমদিকের সংখ্যা। নস্টালজিয়ার জোয়ারে ভাসা পঞ্চাশ কিংবা ষাটের প্রৌঢ় অথবা এখনকার টিনএজ। বই এনে দেওয়ার লম্বা লাইন। কমিকস যোগাড় করতে হিমশিম দীপঙ্করবাবু। ফোন নম্বরের তালিকা দীর্ঘ। হাতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে নম্বর ডায়াল করেন। দেখা গেছে, সব কাজ ফেলে আধঘন্টার মধ্যে ক্রেতা হাজির। তাই যদি বই হাতে দিতে না পারেন খুবই খারাপ লাগে তাঁর।
আরও পড়ুন
একসময় ঘুরে-ঘুরে মাছও বিক্রি করেছেন বইপাড়ার ‘মুশকিল আসান’ সুধন্যদা
ঠিক কী বই আনবেন, তা কখনোই ঠিক করে রাখতে পারেন না আগে থেকে। বইয়ের কালেকশন দেখে ভেবে নেন, কী নিয়ে যাবেন দোকানের জন্য। তবে কখনো কখনো উদ্ভট পরিস্থিতিতেও পড়তে হয়। একবার তিনি এক ভদ্রলোকের আমন্ত্রণে তাঁর লাইব্রেরি গিয়েছিলেন। তিনি কিছু বই দিয়ে দিতে চান। কিন্ত যে বই লাগবে না, ঘর খালি করবার জন্য তিনি সেসব বইও দীপঙ্করবাবুকে নিয়ে যেতে জোর করেন।
খুব নামী কবি যেমন জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া সেরকম অন্য কারোর কবিতার তেমন চল নেই। তবে প্রবন্ধ পড়ার ক্রেতা বাড়ছে। বিশেষ করে কেউ কেউ একেবারে বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ পড়ছেন। সে হয়তো বা পুরনো কলকাতা, অথবা জেলার ইতিহাস, অথবা পুজো কিংবা সাহিত্য সমালোচনা। গল্প উপন্যাসের চল চিরকালীন। তাঁর বাবার বইয়ের দোকান ছিল ডালহৌসিতে। বাড়িতে বইয়ের আনাগোনা সর্বত্র। তাই ছোট থেকে নিজেও পড়তে ভালবাসেন। সমরেশ মজুমদার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, গোয়েন্দা উপন্যাস তাঁর প্রিয়।
কথা বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন বই বিক্রিতে। দোকানে ভিড়। চলে আসার পথে বললেন, ঝুম্পা লাহিড়ি কিংবা অমিতাভ ঘোষ পেতে পারেন অ্যামাজনে কিংবা এখানেও। জয়দেবের গীতগোবিন্দের পুরনো কোনো সংস্করণ কিন্তু ফ্লিপকার্টে পাবেন না।
সত্যিই তো! কলকাতার বইবাজারের শিরা-উপশিরা এইসব পুরনো বইয়ের দোকান। দোকানও হয়তো বলা যায় না। ফুটপাথের ওপরই পসরা সাজিয়ে বসেন দীপঙ্করবাবুরা। কিন্তু তাঁদের কাছে যেসব অমূল্য রত্ন আছে, তা চট করে ঝলমলে কোনো দোকানে পাওয়া যায় কি?