বাঙালির তো পায়ের তলায় সরষে। আর অল্প কিছুদিনের ছুটির গন্তব্য হতেই পারে দীঘা বা অন্য কোনো সমুদ্র সৈকত। তার ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কত না প্রাণীর দেখা মেলে। লাল-কাঁকড়া, চিংড়ি, ঝিনুক, শামুক, তারামাছ, আরও কত। তবে ক্রমশ এইসব প্রাণীর অস্তিত্ব কমে আসছে। এমন আক্ষেপ অনেক পর্যটকেরই। তারই কারণ অনুসন্ধান করলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সুমিত মণ্ডল এবং গবেষক মৌমিতা ঘোষ। সম্প্রতি ‘এলেসেভিয়ার’ প্রকাশিত ‘ইকোটক্সিকোলজি অ্যান্ড এনভারমেন্টাল সেফটি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল সেই গবেষণাপত্র।
কেন হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রসৈকতের নানা প্রাণী? দুটো প্রধান কারণের কথা বললেন সুমিত মণ্ডল। “প্রথমত, দীঘা, মন্দারমনি সহ পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে ট্রলারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া একটা বড়ো কারণ। তার সঙ্গে নানা ধরনের সমুদ্রবিলাসের যানবাহন তো আছেই। এর ফলে জলে যে তেল মিশছে, তা সৈকতের বাস্তুতন্ত্রেও প্রভাব ফেলছে।” বলছেন তিনি। সমুদ্র সৈকতের বালির নিচেই থাকে নানা ধরনের আণুবীক্ষণিক প্রাণী। যাদের মেরিন বেথনিক ফনা বলা হয়। এদের খেয়েই বেঁচে থাকে লাল-কাঁকড়া, চিংড়ির মতো বড়ো প্রাণীরা। যাদের সঙ্গে সৈকতে খেলায় মাতে মানুষ। কিন্তু বালির উপড়ে তেলের আস্তরণ পড়ে যাওয়ায় নিচে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। ফলে আণুবীক্ষণিক উদ্ভিদগুলো সালোকসংশ্লেষ করতে পারে না। এর ফলে একধরনের অক্সিজেনশূন্য অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে মেরিন বেথনিক ফনারাও বাঁচতে পারে না। একই অবস্থা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষেত্রেও হয় বলে মনে করছেন সুমিতবাবু।
“আর অপর একটি কারণ অবশ্যই উষ্ণায়ন। আমরা পরীক্ষাগারে নানা তাপমাত্রায় নমুনা রেখে দেখেছি। উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সংখ্যা কমেছে এইসব প্রাণীদের। আমাদের দেশে তারা এমনিতেই যথেষ্ট সঙ্কটে আছে। আরও কমতে থাকলে বাস্তুতন্ত্রকে আর বাঁচানো যাব না।” প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন ইকোলজি পরীক্ষাগারে ২ মাস ধরে চলেছে পরীক্ষা। এর আগে কোথাও এত দীর্ঘ সময় ধরে এধরনের মিলিত পর্যবেক্ষণ চলেনি। আর নমুনা সংগ্রহ করে আনা হয়েছে তাজপুরের অনতিদূরে একটি পর্যটন বিমুখ এবং দূষণমুক্ত অঞ্চল থেকে। বড়ো বড়ো অংশে বালি কেটে নেওয়া হয়েছে, যাতে আণুবীক্ষণিক প্রাণীদের প্রকৃত সংখ্যাটা বোঝা যায়।
তবে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার অনেক পথ আছে। “পর্যটন শিল্পের উপর নিয়ন্ত্রণ বসানো যায়। সমুদ্রে খনিজ তেল চালিত যানের ব্যবহার প্রথমে কমাতেই হবে। এছাড়া মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া তৈরি করা যায়। যেখানে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। তাছাড়া বিকল্প শক্তি উৎসের দিকে জোর দেওয়া প্রয়োজন। বায়ুবিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুতের সাহায্যেও সামুদ্রিক যান চালানো যায়। এছাড়া বিজ্ঞানসম্মত কোস্টাল অ্যাকোয়াকালচার একটি ভালো বিকল্প হতে পারে। এইসব উপায়ের কথাই আমরা গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছি।” বললেন সুমিত মণ্ডল। এরপর বাকিটা নির্ভর করছে নীতি নির্ধারকদের হাতে আর মানুষের সচেতনতার উপর। তবে সরকার এবং প্রশাসন চাইলে অবশ্যই বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব লাল-কাঁকড়া সহ অন্যান্য প্রাণীদের। শুধু প্রয়োজন কিছুটা পরিকল্পনা।
আরও পড়ুন
বিলুপ্তির পথে বাংলার গেঁড়ি-গুগলি, আশঙ্কার কথা জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্সির দুই গবেষক
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বিলুপ্তির মুখ থেকে ফিরে এল ধূসর নেকড়ে, খুশি বিশেষজ্ঞরা