বাংলায় যেমন কীর্তন, ঝুমুর কিংবা বাউল সঙ্গীত, তেমন ওড়িশার বুকে ছড়িয়ে রয়েছে এমন অসংখ্য লোকশিল্প। বিশেষত পশ্চিম ওড়িশায়। তবে বাংলা বা ভারতের অন্যান্য রাজ্য তো বটেই, এসব লোকশিল্পের বিষয়ে অবগত নন ওড়িশার অধিকাংশ মানুষই। হারিয়ে যেতে বসা এইসকল লোকশিল্প (Folk Art) এবং সংশ্লিষ্ট নেটিভ বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ওড়িশার বালাঙ্গিরে যুবোদয় কলেজের এক অধ্যাপক।
রজত কুমার পাণিগ্রাহী (Rajat Kumar Panigrahi)। ২০১৭ সাল থেকে ওড়িশার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ঘুরে ঘুরে আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং লোকশিল্পের তথ্য সংগ্রহ করে চলেছেন তিনি। তবে অবাক করার বিষয় হল, সাহিত্য কিংবা ইতিহাস অধ্যাপক নন রজত। বরং, তিনি প্রাণীবিদ্যার প্রভাষক। কিন্তু হঠাৎ বিষয় বদলে শিল্প-সংস্কৃতিতে ব্রতী হলেন কেন তিনি?
বছর দশেক আগের কথা। তখনও অধ্যাপনার জগতে আসেননি তিনি। পশ্চিম ওড়িশার এক প্রত্যন্ত গ্রাম ‘রাজকন্যা’-য় বেড়াতে গিয়েছিলেন রজত। সেখানে গিয়ে এক অদ্ভুত বার্ষিক লোক অনুষ্ঠানের সাক্ষী হন তিনি। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ছত্রযাত্রা। সেবার উৎসবের বেশ কিছু ছবি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন রজত। সময়াভাবে এই উৎসবের ইতিবৃত্তান্ত জানা হয়নি কিছুই। পরবর্তীতে ওড়িশায় ফিরে একাধিক লোকসঙ্গীত বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেও এই উৎসব বা শিল্পের সেভাবে কোনো হদিশ পাননি। পাননি কোনো সরকারি নথিও।
এই ঘটনাই যেন চোখ খুলে দেয় রজতের। বুঝতে পারেন, প্রযুক্তিগত দিক থেকে পশ্চিম ওড়িশার গ্রামগুলি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ছোট্ট গণ্ডির মধ্যেই আবদ্ধ থেকে গেছে সেখানকার লোকশিল্প। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর লড়াই। পাশে পান ভাই সত্য পাণিগ্রাহী ও বন্ধু গণেশ প্রধানকে। ওড়িশার প্রান্তিক গ্রামগুলিতে সেসময় মাঝেমাঝেই ‘হানা’ দিতেন তিন বন্ধু। ক্যামেরায় রেকর্ড করে আনতেন সেখানকার লোকগীতি কিংবা নানান হস্তশিল্প।
বিগত পাঁচ বছরে প্রায় হাজারেরও বেশি গ্রামে অভিযান চালিয়েছেন রজত ও তাঁর সহযোদ্ধারা। লোকসঙ্গীতের পাশাপাশি তুলে এনেছেন লোকনৃত্য এবং হস্তশিল্পদেরও। ব্যক্তিগত আগ্রহে নিজে প্রান্তিক লোকশিল্পীদের থেকে নেটিভ বাদ্যযন্ত্রও সংগ্রহ করে থাকেন রজত। তবে সংগ্রহ আর সংরক্ষণ তো এক বিষয় নয়। সাধারণ মানুষের কাছে এইসকল শিল্পদের তুলে ধরতে প্রযুক্তির দ্বারস্থ হন রজত। শুরু করেন একটি বিশেষ ইউটিউব চ্যানেল ‘মাটির কলা’। বর্তমানে এই চ্যানেলেই ধারাবাহিকভাবে নানান বিলুপ্তপ্রায় লোকশিল্পের বর্ণনা এবং বিশ্লেষণ করেন রজত। রয়েছে তাঁর ফেসবুক পেজও।
অন্যদিকে তিন যোদ্ধার দৌলতে ওড়িশার শহরাঞ্চলে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেছে প্রান্তিক শিল্প। খানিকটা হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রান্তিক শিল্পীদের আয়। কমেছে হাটের ওপর নির্ভরতা। বলতে গেলে জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়েও, ওড়িশার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সম্পূর্ণভাবে বদলে ফেলছেন রজত…
Powered by Froala Editor