শুরুটা হয়েছিল মাত্র ১১ বছর বয়সে। সেদিন বিশ্ব পরিবেশ দিবস বা পৃথিবী দিবস ছিল না। নেহাৎই ভালোবাসার তাগিদে স্কুলের মাঠে একটি বটগাছ লাগিয়ে ফেলেছিল ছোট্ট একটি ছেলে। শিক্ষকরা এগিয়ে এসে প্রশংসাও করেছিলেন। কিন্তু কেউই ভাবতে পারেননি একদিন গাছের সঙ্গেই জড়িয়ে যাবে ছেলেটির সমস্ত পরিচয়। আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁকে একডাকে চেনেন সারা ওড়িশার মানুষ। তাঁর নাম গাছস্যার। সরকারি নাম অন্তর্যামী সাহু চাপা পড়ে গিয়েছে সরকারি কাগজপত্রের নিচেই।
১৯৪৬ সালে জন্ম অন্তর্যামী সাহুর। গ্রামাঞ্চলের সবুজে ঘেরা পরিবেশে কেটেছে ছেলেবেলা। কিন্তু বয়স যত বেড়েছে, ততই বদলেছে চারপাশের পরিবেশ। মানুষের সীমাহীন লোভ বদলে ফেলেছে পৃথিবীর খোলনলচে। ছেলেবেলায় গাছ লাগানো ছিল তাঁর শখ। কিন্তু ক্রমশ তাই হয়ে উঠল লড়াইয়ের অস্ত্র। ১৯৭৩ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন অন্তর্যামী। অবাক হয়ে সেদিন দেখেছিলেন, স্কুলের বিস্তীর্ণ মাঠে একটিও গাছ নেই। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে শুরু হল স্কুলের চত্ত্বরকে সবুজ করে তোলার কাজ। দেখতে দেখতে গাছের ছায়া আর পাখির কলকাকলিতে ভরে উঠল চারদিক। ক্লাসরুমের সীমানা পেরিয়ে সেই গাছের ছায়াতেই এক একদিন চলত পড়াশোনা। কিন্ত চারিদিকের সমস্ত দৃশ্যটাই যে বদলে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতেই হবে। বুঝতে পারলেন অন্তর্যামী।
১৯৮৫ সাল থেকে শুরু হল তাঁর একক লড়াই। গাছ লাগানো তো আছেই। কিন্তু সেই গাছ যাতে নিজেই নিজের বংশবিস্তার ঘটাতে পারে, তার দিকেও নজর দিতে হবে। অন্তর্যামী তাই প্রথমেই মৌমাছি সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে শুরু করলেন। নিজের হাতেই এঁকেছেন পোস্টার। আর সেই পোস্টার নিয়ে ঘুরেছেন গ্রামে গ্রামে। মানুষকে বুঝিয়েছেন, একটা ফুল গাছ থেকে ছিঁড়লেও জীবকুলের কতটা ক্ষতি হয়। আর আশ্চর্যের বিষয় হল, গ্রামের তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষরা তাঁর কথা বুঝতেও পেরেছেন। নিজেরাই এগিয়ে এসেছেন সংরক্ষণের কাজে।
এখনও অবধি ৩০ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন ওড়িশার গাছ স্যার। বোধ, নয়গড়, কালাহান্ডি, নবরঙ্গপুর এবং কোরাপুট জেলায় তৈরি করেছেন ৫টি পৃথক পৃথক উদ্যান। কোনোটির নাম ধনলক্ষ্মী উদ্যান, কোনোটার নাম লুম্বিনী উদ্যান। পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন দেশের সংস্কৃতির ইতিহাসকেও। এভাবেই যে মানুষের একান্ত আপন হয়ে উঠেছে প্রতিটি উদ্যান। আজও নিজের হাতে ৫টি উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে চলেছেন গাছ স্যার। তবে বয়স যে ৭৫ ছাড়িয়ে গিয়েছে। শরীর ভেঙে পড়ছে একটু একটু করে। তবে সাধারণ গ্রামবাসীরা তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এই বিষয়ে নিশ্চিত অন্তর্যামী। শুধু আজও তাঁর আশঙ্কা, সাধারণ মানুষদের বোঝাতে পারলেও সরকারি কর্তাদের বোঝাতে পারেননি পরিবেশের প্রয়োজন। আজও একের পর এক উন্নয়নপ্রকল্পের নামে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ এই সমস্ত ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু বাণিজ্যিক সংস্থা এবং সরকারি কর্তাদের সঙ্গে লড়াইয়ে কি মানুষ শেষ পর্যন্ত জিততে পারবে? এই আশঙ্কাই আজও তাড়া করে বেড়ায় গাছ স্যারকে।
আরও পড়ুন
বৃক্ষচ্ছেদন রুখতে গাছের গায়ে ভগবানের ছবি সাঁটা ছত্তিশগড়ে
Powered by Froala Editor