পঞ্চাশের দশক। সোভিয়েত-মার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে তখন বিশ্বজুড়ে। জোটে ভাগ হয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবী। ১৯৫৫ সালে এই বিভাজনের বিরুদ্ধে একত্রিত হয় জোটনিরপেক্ষ ২৯টি এশিয় ও আফ্রিকান দেশ। শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় আয়োজিত হয় বান্দুং সম্মেলন। তবে আলোচনা হলেও, কোনো স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি এই সম্মেলন। ফলত, বছর চারেক পরে আরও এক আন্দোলনের সাক্ষী হয় ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং শহর। এবার জমায়েত হয় গোটা বিশ্বের শিক্ষার্থীরা। সেদিনের সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন এক তরুণ ভারতীয় যুবক। মনোজ দাস।
বিশিষ্ট ওড়িয়া ও ইংরাজি সাহিত্যিক হিসাবেই তিনি পরিচিত। তবে তাঁর জীবনেও লুকিয়ে রয়েছে এমনই এক অজানা অধ্যায়। গত মঙ্গলবার পুদুচেরির ঋষি অরবিন্দ আশ্রমের একটি নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন খ্যাতনামা এই ভারতীয় সাহিত্যিক, অধ্যাপক। বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখ এবং ক্যানসারে ভুগছিলেন তিনি। অবশেষে ইতি পড়ল লড়াইয়ে।
১৯৩৪ সালে ওড়িশার বালেশ্বর জেলার উপকূলবর্তী শাঁখারি গ্রামে জন্ম মনোজ দাসের। বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। স্কুলে পাঠরত তিনি। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাতবদিরা আরতনাদা’। সে বইয়ের রসদ বিপ্লব, আন্দোলনের সুর। বছর খানেক পরে তিনি চালু করলেন একটি স্বতন্ত্র সাহিত্য পত্রিকাও। তবে তখনও পর্যন্ত সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেননি তিনি।
১৯৫১ সালে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাশ করে মনোজ দাস ভর্তি হন কটক কলেজে। বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন কিশোর বয়স থেকেই। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য যেন আরও খানিকটা বাড়িয়ে দিল সেই আগুনের আঁচটাকেই। শুরু হল বামপন্থী মতাদর্শের পথে হাঁটা। হয়ে উঠেছিলেন ওড়িশার অন্যতম এক যুবনেতা। আস্থা ছিল সশস্ত্র আন্দোলনে। আর সেই কারণে একাধিকবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হতে হয়েছে তাঁকে। বদলাতে হয়েছে কলেজও।
আরও পড়ুন
প্রয়াত চন্দ্রাভিযানের পথিকৃৎ তথা ‘ইতিহাসের নিঃসঙ্গতম মানুষ’ মাইকেল কলিনস
১৯৫৯-এর বান্দুং শিক্ষার্থী সম্মেলন থেকে ফেরার পর রাভেনশ’ কলেজ থেকে ইংরাজিতে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করেন মনোজ দাস। আর তারপরেই এক বড়োসড়ো মোড় নেয় জীবন। মার্ক্সবাদী চরমপন্থী যুবনেতাও হঠাৎ বদলে যান মিস্টিকে। উদ্বুদ্ধ হন ঋষি অরবিন্দের ভাবাদর্শে। শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমই হয়ে ওঠে তাঁর ঠিকানা। ১৯৬৩ সাল থেকে দীর্ঘ কয়েক দশক সেখানেই ইংরাজি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়েই চলেছে আধ্যাত্মিক অনুশীলন এবং সাহিত্যচর্চা।
আরও পড়ুন
আবার ঘাতক কোভিড, প্রয়াত শঙ্খ ঘোষের স্ত্রী প্রতিমা ঘোষ
পন্ডিচেরিতে আসার পর থেকেই ইংরাজি সাহিত্যে অভিষেক হয় মনোজ দাসের। পুরাণ, মহাভারত-সহ ঐতিহাসিক কাব্যগ্রন্থের নানান ছবিই প্রতিফলিত হত তাঁর লেখায়। ফিরে ফিরে আসত ফকির মোহন সেনাপতি, ব্যাসদেব কিংবা বাল্মীকির সাহিত্যধারা।
আরও পড়ুন
করোনায় প্রয়াত মানবতাবাদী নেতা মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান
ইংরাজি ও ওড়িয়া দুটি ভাষাতেই লিখেছেন অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস, উপন্যাসিকা। রচনা করেছেন বহু নাটকও। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি শিশুদের জন্যও লিখেছেন একাধিক বই। ‘দ্য এস্কাপিস্ট’, ‘এ টাইগার অ্যাট টোয়াইলাইট’, ‘দ্য সাবমার্জ ভ্যালি অ্যান্ড আদার স্টোরিস’, ‘দ্য ব্রিজ ইন দ্য মুনলাইট নাইট’, ‘সাইক্লোনস’, ‘মিথস’, ‘লেজেন্ডস’, ‘উপকথা শতক’, ‘শেষ বসন্তের চিঠি’, ‘মনোজ দাসঙ্ক কথা ও কাহিনী’ যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্যজগতে অনস্বীকার্য অবদানের জন্য ২০০১ সালে পদ্মশ্রী সম্মান পান মনোজ দাস। গত বছর পুরস্কৃত হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান পদ্মভূষণে। পেয়েছিলেন কলিঙ্গ সাহিত্য পুরস্কার, সাহিত্য অকাডেমি পুরস্কার। তাছাড়াও ঋষি অরবিন্দের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার জন্য সম্মানিত হয়েছেন শ্রী অরবিন্দ স্মৃতি পুরস্কারেও। ওড়িশার স্থায়ী বাসিন্দা না হয়েও, কেবলমাত্র লেখনীর মধ্যে দিয়েই তিনি দশকের পর দশক সমৃদ্ধ করেছেন ওড়িয়া সাহিত্যকে। ‘কিংবদন্তি’-র প্রস্থানে শেষ হল ওড়িয়া সাহিত্যের দীর্ঘ এক অধ্যায়। যে ক্ষতি অপূরণীয়। শোকস্তব্ধ ওড়িশা-সহ গোটা ভারতের সাহিত্যমহল…
তথ্যসূত্র-
১. উইকিপিডিয়া
২. Odia and English author Manoj Das dies at 87; PM Modi mourns, The Indian Express
৩. Kalinga Literary Festival names 'Lifetime Achievement' award after Manoj Das, MENAFN
Powered by Froala Editor