উনিশ শতক, 'অশ্লীল' কলকাতা ও বাঙালির আদিরস-প্রীতি

উনিশ শতকের কলকেতায় এক নতুন রোগ দেখা দিল। সদ্য ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি চারিদিকে অশ্লীলতা খুঁজে পেতে শুরু করল। শুধু খুঁজে পাওয়াই নয়, যেনতেন প্রকারেণ সমাজ থেকে এই অশ্লীলতা দূর করার জন্য একদল বাঙালি বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন। এই শব্দের সঙ্গে বাঙালি আগে পরিচিত ছিল না। বসন্তক পত্রিকায় দেখতে পাই ১৮৭৪ সালে কাঁসারীপাড়ার সঙের মিছিলে গান গাওয়া হয়েছিল— ‘শহরে এক নূতন হুজুক উঠেছে রে ভাই/অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই’। নেহাত নিরীহ উপলব্ধির গান। এককালে লোকসংস্কৃতিতে, গানে, কবিতায়, ছড়ায় প্রায়ই যৌনগন্ধ ও বর্ণনা থাকত। তা দোষের তো বিবেচিত হতই না, বরং ভারতচন্দ্র বিদ্যাসুন্দর লিখে রীতিমতো নাম করেছিলেন। বৈষ্ণব পদাবলীতেও যখন লেখা হল ‘কদলি রোপব হাম গুরুয়া নিতম্ব/আম্র পল্লভ তাহে কিঙ্কিনি সুঝম্প’, তখনও সমাজে গেল গেল রব ওঠেনি। গ্রাম্য প্রবাদে ডবকা, মাগী, ভাতার, ইত্যাদি তো মুখের লব্জ ছিল।

বাঙালিদের তথা ভারতীয়দের এই যে অশ্লীলতার প্রতি আলাদা মনোযোগ, তাঁর অনেকটাই ঔপনিবেশিক শাসনের দান। ইংরেজরা স্বভাবতই অনেক বেশি পোশাক পরতেন, তাঁদের পরিবেশ সেই পোশাকের উপযুক্ত। এদেশে এসে কম পোশাকের পুরুষ এবং স্ত্রীদের দেখে তাঁদের দৃষ্টিকটু লাগা শুরু হল। তাঁদের শিষ্টাচারবোধে আঘাত লাগত। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে যেখানে টেবিলের পায়াতেও মোজা পরিয়ে রাখা হত, তাঁরা এই দৃশ্যকে চরম অশ্লীল ভাবলেন। তাঁদের দেখাদেখি ইংরাজি শিক্ষিত বাঙালিও নিজেদের আপন ঔপনিবেশিক কর্তার দৃষ্টিতে দেখল এবং লজ্জা পেল। 

উনিশ শতকের শুরুতে প্রায় একসঙ্গে দুটো ঘটনা ঘটে। মুদ্রণযন্ত্রের প্রবর্তনের ফলে কলকাতায় বাংলা বইয়ের একটা ব্যাপক বাজার শুরু হয়। একই সঙ্গে খ্রিস্টান মিশনারিরা প্রচার করতে থাকেন দেশীয় সাহিত্যের নামে যা ছাপা হচ্ছে তা অশ্লীলতা আর কুরুচিতে ভর্তি। স্বয়ং বেথুন সাহেব এই মর্মে গৌরদাস বসাককে একটি চিঠি লেখেন, গৌর তা মেনেও নেন। অভিযোগটি আংশিক সত্য। কিন্তু পুরো নয়। সেই সময় শোভাবাজার কালাখানা অঞ্চলে বিরাট একটা বটগাছ ছিল। সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় শহরের মানুষরা বিশ্রাম নিতেন, আড্ডা দিতেন, গান বাজনাও করতেন অনেকে। সঙ্গে বসত সস্তার বইয়ের পসরা। এইসব বই ছিল বিশ্বনাথ দেব নামে একজনের ছাপা। ১৮১৮ সালে বটতলা অঞ্চলে বা উত্তর কলকাতায় তিনিই প্রথম ছাপাখানা খোলেন। বহুকাল অবধি এই বান্ধা বটতলাই ছিল অন্য প্রকাশকদের ঠিকানা। তবে এই বইগুলোর কিছু বিশেষত্ব ছিল। একেবারে সাধারণ কাগজে সস্তায় ছাপা হওয়াতে এইসব বইগুলোর ছাপার খরচ কম। ফলে দাম কম, আর প্রচুর বিক্রি। কম দামে মানুষ কিনতে শুরু করল তাদের পছন্দমতো বই। 

কী নেই তাতে? ধর্ম থেকে যৌন কেলেঙ্কারি, জ্যোতিষ থেকে নেশা-বেশ্যা-আমোদ বিষয়ে নানা বই, যা মূল ধারার প্রকাশকরা প্রকাশ করতেন না। এলিট পাঠকরাও নাক কোঁচকাতেন। শিয়ালদহ, গরানহাটা, বড়োবাজার, এন্টালি, ডালহৌসি, শ্যামবাজার হয়ে এমন বিরাট বইয়ের বাজার আগে কেউ দেখেনি। করি। বটতলার বইতে ব্রাত্য হিসেবে কিছু ছিল না। তবে মূলত বটতলার বই ছিল দুরকম। ধর্মবিষয়ক, যাতে রামায়ণ, মহাভারত থেকে অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর ছাপা হত, অথবা নানা নকশা বা প্রহসন। এই নকশা বা প্রহসনে চেষ্টা করা হত সমকালকে ধরার। তাতে নানা বিতর্কও থাকত। যৌন কেলেঙ্কারি, মদ্যপান, বেশ্যাশক্তি, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি। 

আরও পড়ুন
যৌনশিক্ষার অভাব মেটাতে লড়ছেন দিল্লি তরুণী ‘সেক্স কোচ’

আরও পড়ুন
যুদ্ধ, প্রেম, ‘বিকল্প যৌনতা’ ও হাজার তারার গল্প

তবে বটতলার বইয়ের আসল খ্যাতি ছিল তাঁর আদিরসের জন্য। ১৮২০ সালের ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া চারটি আদিরসাত্মক বইকে চিহ্নিত করে। রসমঞ্জরী, রতিমঞ্জরী, আদিরস আর শৃঙ্গারতিলক। ধীরে ধীরে এই জাতীয় বইয়ের চাহিদা এত বেড়ে গেল যে বিশ্বনাথ দেব সব ছেড়ে এই ধরনের বইই প্রকাশ করতে থাকেন। এই বিষয়ে তাঁর আবার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। অন্নদামঙ্গলখ্যাত গঙ্গাকিশোর আর লাল্লুজি। ১৮৫৫ সালে রেভারেন্ড জেমস লং যখন বাংলা বইয়ের তালিকা প্রকাশ করলেন সেই তালিকায় কামশাস্ত্র, বেশ্যারহস্য, প্রেমবিলাস, রসসাগর, রতিকেলি ইত্যাদির মত বই বড়ো জায়গা জুড়ে ছিল। লং সাহেব এঁদের ফরাসি সাহিত্যের কুৎসিতরূপের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সঙ্গে থাকত উডকাট ব্লকে আঁকা ছবি। সম্ভোগরত্নাকর বইটিতেই যেমন ১৬টি ‘কামোদ্দীপক ছবি’ ছিল, দূতীবিলাসে ‘বিশদে বর্ননা করিবার জন্য’ ১২টি ছবি। অধিকাংশ লেখকেরই নাম জানা যায় না, বা তাঁরা ছদ্মনামে লিখতেন। তবু বেণীমাধব চ্যাটার্জী, কালীকৃষ্ণ দাস, মধূসূদন শীল, পঞ্চানন ব্যানার্জীর নাম পাওয়া যায়। এই শেষের জন ছিলেন বটতলার আদিরসের শেক্সপিয়ার। তাঁর চারখানা আদিরসের বই ‘রমণী নাটক’, ‘রসিক তরঙ্গিণী’, ‘প্রেম নাটক’ আর ‘রস তরঙ্গিণী’ বটতলার বেস্টসেলার ছিল। তাতে শুরুতেই হুঁশিয়ারি ‘এই পুস্তক আমরা রীতিমত গবর্ণমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টে রেজিস্টারী করিয়া লইয়াছি’ কেউ পুর্নমুদ্রণ করলে যে ‘সমুচিত দণ্ড’ পাইবেন, তাও বলা আছে এতে। কিন্তু এত আয়োজনের পরে ভিতরে যা লেখা হত, তা সেই ভারতচন্দ্রের অক্ষম অনুকরণ বাদে কিছু না। একটু উদ্ধৃতি না দিলেই নয়। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূতীবিলাসে বিবাহিত নায়িকা অনঙ্গমঞ্জরীর সঙ্গে তাঁর আগের প্রেমিক শ্রীদেবের মিলন হয় এক দূতীর মাধ্যমে। নায়ক আসে বৈষ্ণব সেজে। আর তারপর—

আরও পড়ুন
ধর্ষণ শুধুই যৌনাঙ্গ-নির্ভর নয়; যৌনতার ভাষা শিখতে হবে প্রথমে : মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়

‘এস ও হে প্রাণনাথ অনঙ্গ কহিল
সে বাক্যেতে কামানল দ্বিগুণ বাড়িল
কামের সাগর প্রেমে উঠে উথলিয়া
নাগর নিভাতে চায় মন্থন করিয়া।’

এরপরের দীর্ঘ বর্ণনা আর নাই বা দিলাম। খানিকবাদে শুরু হল বিপরীত বিহার। এইসব দৃশ্যে লেখকের ডিটেলিং অবাক করার মতো। 

‘মৃদুহাস্য মুখে অতিচিত্ত লোভা
যামিনীতে যেন দামিনীর শোভা।
কটিদেশ তুলে ঘন শব্দ করে
জলবিন্দু তাহে তবু নাহি সরে’

ভবাণীচরণ অবশ্য শুরুতেই নিজের সপক্ষে বলে রেখেছেন তিনি বড়োবাজারের বাবু নিমাইচরণ মল্লিকের সপ্তমপুত্র স্বরূপচন্দ্রকে খুশি করতে এই বই লেখেন। এ এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য। নব্য বাবুরা লেখক কবিদের দিয়ে কমিশনড পর্নোগ্রাফি যে লেখাতেন, সেই প্রমাণও এখানেই পাওয়া যায়।  

কিন্তু এই সময়ই এত আদিরসের বইয়ের চাহিদা দেখা দিল কেন? নতুন গজিয়ে ওঠা বাবু কালচার আর মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা ভারতচন্দ্র বাবুদের রঙের নেশা জমিয়ে দিল। ভারতচন্দ্র পড়ে ক্লান্ত বাবুরা নিত্য নতুন আদিরসের সাহিত্য খোঁজ করতে লাগলেন। বেশ্যাবাড়িতে যা পাঠ করলে গা গরম হয়ে ওঠে। মনে পুলক জাগে। খোঁজ পড়ল এমন জিনিস আর কী আছে? বাবুদের কপাল ভালো। প্রকাশকরা খদ্দেরের আশাতেই বসে ছিলেন। তাঁরাও ডিমান্ড এন্ড সাপ্লাই মেনে দিনের পর দিন সস্তায় ক্রমাগত আদিরসের বই ছেপে যেতে লাগলেন। তৈরি হল বইয়ের বাজার। এমন বাজার যে হতে পারে, তা আগে কেউ ভাবেনি। ১৮১৭ সালে যেখানে বইপ্রকাশের হার ছিল ১০.২৪ শতাংশ, একা বটতলার জোরে ১৮৫২ সালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৯১.৮৯ শতাংশে। আদিরস বটতলার সংজ্ঞা নতুন করে তৈরি করে। এখনও বটতলার বই মানে লোকে আদিরসের বইই ভাবে। সেই বাজারে ভালো বই প্রকাশ করলেও বিক্রি হত না। সমাচার দর্পণের এক খবরে দেখি এক ব্রাহ্মণ কর্মলোচন নামে এক সংস্কৃত বইয়ের বাংলা অনুবাদ ‘অতি যত্নে ছাপেন’। বাবুরা সেই বইকে ‘আদিরসজ্ঞানে হস্তে করেন পরে কিঞ্চিৎ দর্শনে রজ্জুজ্ঞানে সর্পধারণ জ্ঞান করিয়া দূরে নিক্ষেপ করেন’। 

মূলত জেমস লং-এর উদ্যোগেই ইংরেজ প্রশাসন ১৮৫৬ সালের জানুয়ারিতে একটি আইন প্রণয়ন করেন যাতে ‘কুৎসিত ছবি ও শৃঙ্গাররস ঘটিত পুস্তক প্রকাশ’ আইনত অপরাধ বলে গণ্য হল। এই দেশে অশ্লীলতা নিয়ে আইন সেই প্রথম। মজার ব্যাপার এর পরের বছরই খোদ ইংল্যান্ডে এই আইন কার্যকরী করা হল। লং-এর আবেদন অনুযায়ী তিন শীল গ্রেপ্তার হলেন। মহেশ, বিশ্বম্ভর আর মধুসূদন। প্রথম দুইজন দোষ কবুল করে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিয়ে রেহাই পান। তাঁরা এটাও স্বীকার করেন গ্রেপ্তার হবার ঠিক আগেই সে এই ধরনের কয়েকশো বই পুড়িয়ে ফেলেছে। জীবনে আর এসব ছাপাবে না। মধুসূদনের একশো টাকা জরিমানা হয়, কারণ সে প্রকাশকের পাশাপাশি এই ধরনের বইয়ের লেখকও ছিল। 

আইনের ঠেলায় কিছুদিন সব চুপচাপ। ১৮৬৩ সালে তেইশটি কামোদ্দীপক ছবি সহ লজ্জতন্নেছা ছাপা হল। প্রকাশ মাত্রে বইটি বেস্ট সেলার। স্বয়ং কেশবচন্দ্র সেন এঁর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগলেন। গঠন করলেন ‘অশ্লীলতা নিবারণ সমিতি’। অনেকেই যোগ দিলেন তাতে। এঁদের স্বেচ্ছাসেবকরা প্রকাশকের ঘরে ঢুকে ঢুকে অশ্লীল বই খুঁজত, ফেরিওয়ালার ঝাঁকা নামিয়ে দেখত অশ্লীল বই আছে কিনা, কেউ রাস্তায় অশ্লীল গান করলে তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দিত। এঁদের ভয়ে বই বিক্রেতাদের নাভিশ্বাস। কোনটা শ্লীল আর কোনটা অশ্লীল, তাঁর কোনো নির্দিষ্ট সীমা না থাকায় অপছন্দ হলেই এঁরা সেই বইকে অশ্লীল দেগে দিত। এঁরা হানা দিতে আসছে শুনে আতঙ্কে চুঁচুড়ার প্রকাশক যদুনাথ মুখোপাধ্যায় নিজের প্রকাশনার আটশোটি বই পুড়িয়ে ফেলেন। শেষে বটতলার প্রকাশকরা চাঁদা তুলে ব্যারিস্টার নিয়োগ করলেন। মামলার ফল প্রকাশকদের বিরুদ্ধেই গেল। সমিতির সদস্যরা সেইদিনই ‘মামলার ফলে উৎসাহিত হইয়া কয়েকজন গরীব হকারকে পুলিশের হস্তে অর্পণ করিলেন’। 

এঁদের অতি উৎসাহে দাশরথি রায়ের পাঁচালী বন্ধ হল, কাঁসারিপাড়ার সঙ উঠে যাবার যোগাড় হল, ভারতচন্দ্র নাম উচ্চারণে পুলিশের কাছে জরিমানার উপক্রম হল। ধীরে ধীরে এঁরাই সমাজের সাধারণ মানুষদের থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। শুরুতে এঁদের যারা প্রশংসা করতেন, এঁদের বাড়াবাড়ি দেখে তাঁরাই এঁদের বিরোধী হলেন। এদিকে আলিপুরের এজলাসে এক হকারকে উপস্থিত করা হল অশ্লীল বই বিক্রির দায়ে। ডেপুটি তাঁকে জিজ্ঞেস করায় সে বলে সে আগেও একই কাজ বহুবার করে শাস্তি পেয়েছে। এক অপরাধে কতবার সে দণ্ড পাবে? ডেপুটির নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি বিরক্ত হয়ে লোকটিকে তিনমাসের জেলের সাজা দেন। বাজেয়াপ্ত বইগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়। 

সময় বয়ে যায়। অশ্লীলতা নিবারণী সমিতির উৎসাহে ভাটা পড়ে। পত্রিকায় ব্যঙ্গ করে লেখা হয়, এঁদের এবার বটতলার বদলে নিমতলাতে গেলেই ভালো হয়। বাঙালির বটতলার অশ্লীল বইয়ের ব্যবসা আমার রমরমিয়ে জমে ওঠে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More