— নমস্কার, আমি অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়।
ফোনের রিসিভার তোলার পরই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে এসেছে কথাটা। কিন্তু কে এই অরুণ কুমার? কেনই বা ফোন করেছেন তিনি? এসব হিসেবই ঘুরছিল তাঁর মাথার মধ্যে। নীরবতা ভাঙলেন রিসিভারের উল্টোদিকের মানুষটাই। প্রশান্ত মায়ামাখা গলায় বলে উঠলেন, “দিদিভাই, আমি তোমাদের উত্তমকুমার গো।” পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক। ১৯৫৮-৫৯ সালের কথা। এভাবেই ফোনালাপে উত্তরকুমারের সঙ্গে ‘আলাপ’ হয়েছিল কিংবদন্তি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুমিত্রা সেনের (Sumitra Sen)।
একরাশ আশা নিয়েই নতুন বছরের পথ চলা শুরু হলেও, ফের ভেসে এক তারা খসার গল্প। বহুদিন ধরেই একাধিক বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী। গত ডিসেম্বর মাসে, ঠান্ডা লেগে আক্রান্ত হন জ্বরে। বুকে জমেছিল সর্দি। ভর্তি করতে হয়েছিল হাসপাতালে। সেখানেই ধরা পড়ে ব্রঙ্কো-নিউমোনিয়া। গতকাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়িতে ফেরেন অশীতিপর গায়িকা। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আজ ভোরেই প্রয়াত হন তিনি। বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।
এ এক নীরব চলে যাওয়া। বাংলা সঙ্গীতজগৎকে সুমিত্রা উপহার দিয়েছিলেন অসংখ্য কালজয়ী গান। অথচ, হেমন্ত, মান্না, সন্ধ্যা কিংবা লতার মতো কোনোদিনই কি তেমন মঞ্চ পেয়েছিলেন তিনি? যেন তাঁদের সহশিল্পীর পরিচয়ই জুটেছিল সুমিত্রার নামের পাশে। অবশ্য, সুমিত্রা বড়ো শিল্পী ছিলেন কি ছিলেন না— এই লেখা তার বিশ্লেষণ নয়। বরং, ব্যক্তি সুমিত্রাকে ফিরে দেখাই এই লেখার উদ্দেশ্য।
বাড়িতে গানের পরিবেশ ছিল চিরকালই। এমনকি কৈশোরে সুমিত্রার হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের কাছেই। মায়ের কাছেই নেওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপির পাঠ। অবশ্য সঙ্গীতকেই পেশা করে নেবেন তিনি— এমনটা ভাবেননি কোনোদিনই। পরবর্তীতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গানই যেন হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাঁর কথায়, ‘আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ’।
তবে মজার বিষয় হল, অধিকাংশ বাঙালির কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী হিসাবে পরিচিত হলেও, তাঁর পেশাদার সঙ্গীতজীবন শুরু হয়েছিল নজরুলগীতি দিয়েই। ১৯৫১ সাল সেটা। তখনও পর্যন্ত তিনি সুমিত্রা সেন হয়ে ওঠেননি। কুমারী সুমিত্রা দাশগুপ্ত নামে রেকর্ড আকারে প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর দুটি গান। ‘গোঠের রাখাল বলে দে রে’ এবং ‘বেদনার বেদী তলে’। দুটিই নজরুলগীতি। পরবর্তীতে পল্লিগীতির পথ ঘুরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে পা রাখা। সিনেমার গান তারও পরে।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই আকাশবাণীর শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন সুমিত্রা। ব্লতে গেলে এই আকাশবাণীর দৌলতেই সিনামার দুনিয়ায় পা রাখা তাঁর। এই লেখার শুরু হয়েছিল যে গল্প দিয়ে, সেখানেই ফিরে যাওয়া যাক বরং। সেটা ১৯৫৮-৫৯ সাল। উত্তমকুমার তখন কলকাতার বাইরে গেছেন শ্যুটিং-এ। সঙ্গে ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। শ্যুটিং শেষে বসেছে আড্ডার আসর। গান চলছে ট্রাঞ্জিস্টারে। ঘড়ির কাঁটায় রাত পৌনে এগারোটা। আকাশবাণীর শেষ অনুষ্ঠান চলছে তখন। এমন সময় রেডিও-তে বেজে ওঠে ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। না, পরিচিত কোনো শিল্পী নয়। এক আনকোরা তরুণ শিল্পীর কণ্ঠেই বাজছে এই গান।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গৌরীপ্রসন্নের কাছে উত্তমকুমার জানতে চেয়েছিলেন এই অপরিচিত কণ্ঠটি কার? ঘটনাচক্রে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আবার সুমিত্রার স্বামীর সহপাঠী। ফলে, তরুণ শিল্পীর পরিচয় তো বটেই, একইসঙ্গে পেয়েছিলেন ফোননম্বর এবং যোগাযোগের ঠিকানাও। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ফোন। সেই বার্তালাপ। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, উত্তমের পরিচয় পেয়ে হাত থেকে ফোন পড়ে যাওয়ার পরিস্থিতি হয়েছিল সুমিত্রার। তাঁর পরবর্তী ছবিতে গান গাইতে হবে ‘দিদিভাই’-কে, অনুরোধ করেছিলেন উত্তম। না, সেই অনুরোধ ফেরাননি সুমিত্রা। বরং, প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত, পল্লিগীতি, নজরুলগীতির বাইরে গিয়ে পা রেখেছিলেন সিনেমার জগতে।
‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে’— ১৯৬০ সালে প্রকাশিত ‘শুন বরনারী’ ছবিতে এই গানটির মধ্যে দিয়েই প্লে-ব্যাক সিঙ্গার হিসাবে অভিষেক হয়েছিল সুমিত্রার। তবে শুধু সিনেমামহলেই নয়, উত্তমকুমারের সঙ্গে সুমিত্রার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। একাধিকবার সুমিত্রার বাড়িতে এসেছেন আড্ডা দিতে। ইন্দ্রাণী সেনের বিবাহানুষ্ঠানেও হাজির হয়েছেন উত্তম। আবার কোনো কোনো ফাংশানে সুমিত্রা সেনের পাশে দাঁড়িয়েই ঘোষকের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
‘শুন বরনারীর’-র পর ‘কাচের স্বর্গ’, ‘গৃহদাহ’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘বসন্ত’, ‘বর্ষা মঙ্গল’— একের পর এক বাংলা ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছেন সুমিত্রা। সঙ্গীতপ্রেমীদের উপহার দিয়েছেন একের পর এক সুপারহিট। মজার বিষয় হল, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে’ গানটিও আসলে হওয়ার কথা ছিল তাঁর কণ্ঠেই। তরুণ মজুমদারের অনুরোধে সেই গানের রেকর্ডও করেছিলেন সুমিত্রা। রেকর্ডিং-এর পর বহু মানুষের প্রশংসাও পেয়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত সিনেমায় গানটি যায় লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে। সঙ্গীত পরিচালক ও প্রযোজকদের সিদ্ধান্তে লজ্জিত তরুণ মজুমদার ফোনে বিষয়টি জানিয়েছিলেন সুমিত্রাকে। পরবর্তীতে বেসিক রেকর্ড থেকে সুমিত্রার কণ্ঠে প্রকাশ পায় এই গান। নেপথ্যে ছিলেন তরুণবাবুই। যা হয়ে উঠেছিল সে-যুগের ট্রেডমার্ক।
সবমিলিয়ে জীবদ্দশায় দেড়শোরও বেশি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন তিনি। গেয়েছেন অসংখ্য ছায়াছবির গান, পল্লিগীতি। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, বাংলা সঙ্গীতজগতের অন্যতম পেশাদার শিল্পী হয়েও, আদ্যোপান্ত সংসারী ছিলেন সুমিত্রা। তারকাজীবনের পাশাপাশিই একা হাতে সামলেছেন সংসার। ইন্দ্রাণী, শ্রাবণী— দুই সন্তানকে গান শেখানো, পড়ানো থেকে শুরু করে মানুষ করা। শিল্পীজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের সামঞ্জস্য বিঘ্নিত হতে দেননি কখনোই। সঙ্গীতজগতে সাফল্য, খ্যাতি, জনপ্রিয়তার ঊর্ধ্বে গিয়ে সেখানেই হয়তো আর পাঁচটা শিল্পীর থেকেই আলাদা হয়ে যান তিনি। এমন এক ব্যক্তিত্বেও প্রয়াণে বাংলা সঙ্গীতজগৎ থেকে মুছে গেল আরও একটি বর্ণময় অধ্যায়, তাতে আর আশ্চর্য কী?
তথ্যসূত্রঃ
মা ও মেয়ে.. : সুমিত্রা সেন, ইন্দ্রাণী সেন ও শ্রাবণী সেন - চৈতালি দাশগুপ্ত, সাক্ষাৎকার (জুন ২০১১), ডিডি বাংলা
Powered by Froala Editor