সন্দীপ দত্ত: বাংলা লিটল ম্যাগাজিন ও এক অদম্য লড়াইকাহিনি

১৯৭২ সাল। ন্যাশনাল লাইব্রেরি। মেঝেতে স্তূপাকার করে জমানো হয়েছে অজস্র লিটল ম্যাগাজিন। কোনোটির বয়স বছর দশেক, কোনোটি আবার ৫০-৬০ বছরের পুরনো। এককথায় বলতে গেলে, সাহিত্যপ্রেমী যে-কারোর কাছেই সে-সব মণিমাণিক্য। কিন্তু ব্যাপার কী? এভাবে মেঝেয় লুটোপুটি খাচ্ছে কেন তারা? জঞ্জালের মতো এইসব পত্রিকা নাকি ফেলে দেওয়া হবে জাতীয় লাইব্রেরি থেকে! বিষয়টা বুঝতেই রক্ত ছুটেছিল কলেজপড়ুয়া তরুণ এক ছোটো পত্রিকার সম্পাদকের শিরায় শিরায়। না, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেননি তিনি। বরং, নিঃশব্দে শুরু করেছিলেন এক আশ্চর্য বিদ্রোহ। আশ্রয় দিয়েছিলেন ফুটপাথে ফেলে দেওয়া লিটল ম্যাগাজিনদের।

সন্দীপ দত্ত (Sandip Dutta)। বাংলার যে-কোনো লিটল ম্যাগাজিন করিয়ের কাছেই তিনি অভিভাবক। আশ্রয়ের জায়গা। লিটল ম্যাগাজিন চর্চা, আঞ্চলিক সাহিত্যকে জিইয়ে রাখা বা ছোটো পত্রিকার লেখক-সম্পাদকদের প্রশ্রয় জোগানো তো বটেই, লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস সংরক্ষণে গোটা জীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে কিছুদিন আগেই তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। হয়েছিল অস্ত্রোপচার। তবে বিফলে গেল চিকিৎসকদের প্রচেষ্টা। আজ সন্ধ্যায় চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন কিংবদন্তি সাহিত্যকর্মী। বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। 

১৯৫১ সাল। কলেজস্ট্রিটের ১৮এম ট্যামার লেনের বাড়িতে জন্ম সন্দীপ দত্তের। ছোটো থেকেই সাহিত্যের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় সম্পর্ক। তবে ক্লাসিক্যাল লিটারেচারের বদলে তাঁকে বেশি টানত ছোটো পত্রিকা। শখ ছিল সংগ্রহের। কলেজস্ট্রিটের পথে ঘুরে ঘুরেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাচীন পত্রিকাদের তিনি নিয়ে আসতেন নিজের বাড়িতে, সঙ্গে পেপার কাটিং সংগ্রহ করার নেশা। কলকাতার বুকে কোথাও সাহিত্য সভা হলে, সেখানেও নিঃশব্দে হাজির হতেন তরুণ সন্দীপ। 

১৯৭০ সাল। কলেজে পা রাখার পরই স্বতন্ত্র একটি ছোটো পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন তিনি। ‘পত্রপুট’। তার বছর দুয়েক পরই ন্যাশনাল লাইব্রেরির সেই আশ্চর্য ঘটনা। যা শুধু সন্দীপ দত্তের জীবনই নয়, বদলে দিয়েছিল বাংলার লিটল ম্যাগাজিনের পরিমণ্ডলকেও। 

ফিরে যাওয়া যাক সত্তরের সেই সাদা-কালো দিনগুলোতে। ১৯৭২-এর ২৭-৩০ সেপ্টেম্বর। এক অভিনব বিদ্রোহের মশাল জ্বালিয়েছিলেন সন্দীপ দত্ত। জাতীয় লাইব্রেরি থেকে লিটল ম্যাগাজিন উজাড় করে দেওয়ার প্রতিবাদে নিজের বাড়িতেই আয়োজন করেছিলেন এক আশ্চর্য গ্রন্থ প্রদর্শনীর। না, কবিতা, গল্প কিংবা উপন্যাস নয়, বরং ফুটপাথ থেকে কুড়িয়ে আনা লিটল ম্যাগাজিন দিয়েই সাজিয়ে তোলা হয়েছিল এই প্রদর্শনী। পাশে দাঁড়িয়েছিলেন প্রতিবেশী, শিল্পী ও সতীর্থ শুভাপ্রসন্ন। 

সেই শুরু। তারপর বয়ে গেছে বহু ঝড়জল। পেরিয়েছে ইমার্জেন্সির অন্ধকার অধ্যায়। ’৭৮ সালে ট্যামার লেনের পৈতৃক ভিটেয় একতলার বৈঠকখানায় তিনি গড়ে তোলেন আশ্চর্য এক গ্রন্থাগার। সেখানে নাকি শুধুমাত্র পাওয়া যাবে ছোটো পত্রিকা। মাত্র ৬৫০ পত্রিকা সম্বল করেই শুরু হয়েছিল কলকাতার এই প্রথম লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রহশালা— ‘লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি বাংলা সাময়িকপত্র পাঠাগার ও গবেষণাকেন্দ্র’। ১৯৮৬ সালে যা পরিচিতি পায় ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র’ নামে। পরবর্তীতে বিভিন্ন কাগজের লক্ষাধিক সংখ্যার আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে ওঠে সন্দীপ দত্তের ছোট্ট এই বৈঠকখানা।

তবে শুধুমাত্র এই লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠাতা বলা হলে অবমূল্যায় করা হবে তাঁকে। আসলে তাঁকে বাংলা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের অন্যতম ধারক, পৃষ্ঠপোষক এবং অভিভাবক বলা হলেও অত্যুক্তি করা হয় না এতটুকু। লিটল ম্যাগাজিনের অধিকার, সম্মান প্রতিষ্ঠার জন্যেও যে আজীবন লড়াই করে গেছেন তিনি। 

১৯৮২ সাল সেটা। লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে তাঁর গবেষণার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। হতাশ হননি সন্দীপবাবু। বরং বছরখানেক বাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই আয়োজন করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী ও আলোচনাসভার। হাজির করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, বার্ণিক রায়, দেবকুমার বসুর মতো ব্যক্তিত্বদের। না, সকলে সাদরে গ্রহণ করেননি তাঁর এই উদ্যোগ। সুকুমার সেন সাফ জানিয়েছিলেন, লিটল ম্যাগাজিন আসলে জঞ্জাল। 

সুকুমারের এই কটূক্তিকেই পরবর্তীতে হাতিয়ার করেন সেন সন্দীপ দত্ত। ‘পত্রপুট’-এর বইমেলা সংখ্যায় বড়ো বড়ো করে ছাপা হয়েছিল ‘জঞ্জাল রাবিশকে প্রশ্রয় দেবেন না’। সঙ্গে ‘লিটল ম্যাগাজিন কিনুন/ লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন’ স্লোগানে সাজানো টুপি পরে, বইমেলায় প্রচার শুরু করেন তিনি। বলতে গেলে তাঁর এই অক্লান্ত লড়াই লিটল ম্যাগাজিন করিয়েদের এনে দিয়েছে দাঁড়াবার প্ল্যাটফর্ম। বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হওয়া আজকের লিটল ম্যাগাজিন মেলাগুলিও তাঁর আয়োজিত লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনীর এক বিবর্তিত রূপ নয় কি?

অবশ্য শুধু পত্রিকাই নয়। একইসঙ্গে লোকশিল্পেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন সৃজনশিল্পী সন্দীপ দত্ত। তাঁর লাইব্রেরিতে গেলেই আন্দাজ পাওয়া যাবে তাঁর শিল্পরুচির। তাছাড়াও কলকাতার বুকে লেখকব্যাঙ্ক তৈরি, একাধিক ছোটো পত্রিকা ও গ্রন্থের সম্পাদনা, শিক্ষকতা— প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরব উপস্থিতি তাঁর। অসুস্থতা সত্ত্বেও শেষ বয়সে হাজির হতেন বাংলার বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন মেলা, বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের টেবিলে টেবিলে। কাঁপা হাতেই সংগ্রহ করতেন পত্রিকার নতুন সংখ্যা। ইতিহাস, আঞ্চলিক সাহিত্য ও বাংলা ভাষা সংরক্ষণের প্রতি এ এক অকৃত্রিম ভালোবাসাই বটে। এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়াণ অভিভাবকহীন করে তুলল দুই বাংলার সমস্ত লিটল ম্যাগাজিন করিয়েদের। ছাদ হারালেন ছোটো পত্রিকার সম্পাদক, কর্মী, লেখক ও গবেষকরা...

Powered by Froala Editor