‘এক উগ্র রাজনৈতিক জগতে আটকে পড়া একজন ভোগবাদী, আমি এভাবেই নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করি।’
এই আপ্তবাক্যের মধ্যে যেমন মিশে রয়েছে এক গূঢ় দর্শন, তেমনই তার গোপন কুঠুরিতে শায়িত রয়েছে দীর্ঘশ্বাস, ক্ষীণ আর্তি, ক্ষমতালোভীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ার যন্ত্রণাও। রাজনৈতিক পরিকাঠামো, দায়বদ্ধতার শৃঙ্খলে আটকে পড়ে যেন নিজের কণ্ঠস্বর, আদর্শ, মতবাদকেই হারাতে বসেছিলেন লেখক। দমবন্ধ হয়ে উঠেছিল তাঁর আশেপাশের পরিবেশ। সেই ক্ষোভকেই দর্শনে মোড়কে মুড়ে সাহিত্যের রূপ দিয়েছিলেন তিনি।
মিলান কুন্দেরা (Milan Kundera)। কাফকা-পরবর্তী যুগের চেক সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ তিনি। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক— সাহিত্যের প্রায় সমস্ত শাখাগুলিতেই অবাধ বিচরণ ছিল তাঁর। বিগত কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন মিলান। দীর্ঘ রোগভোগের পর গতকাল ফ্রান্সের প্যারিস শহরে নিজের ফ্ল্যাটেই প্রয়াত হন কিংবদন্তি বামপন্থী সাহিত্যিক। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত করে চেকোস্লোভাকিয়ার বার্নো শহরে অবস্থিত মিলান কুন্দেরা লাইব্রেরির কর্তৃপক্ষ। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর।
১৯২৯ সালে বার্নোতে জন্ম চেক আখ্যানকারের। অবশ্য মিলানের বিশ শতকেরও অন্যতম ‘ডার্ক নভেলিস্ট’ হয়ে ওঠার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল সঙ্গীতের মাধ্যমে। বাবা লুডভিক ছিলেন সে-দেশের খ্যাতনামা পিয়ানোবাদক। বাবাই ছিল তাঁর প্রথম সঙ্গীতশিক্ষক। সেই সূত্র ধরেই মিলান পা রাখেন শিল্পজগতে। লেখালিখির শুরু অবশ্য আরও খানিকটা পরে।
১৯৪০-এর দশকের শেষ দিক। একটু একটু করে নিজেকে সারিয়ে তুলছে বিশ্বযুদ্ধোত্তর চেকোস্লোভাকিয়া। ক্রমশ সেখানে শক্তিশালী হচ্ছে বামপন্থা। শিল্পচর্চার সূত্রে সেই স্রোতেই গা ভাসালেন মিলান। এখানে বলে রাখা ভালো, মিলানের জন্ম এমন একটি প্রজন্মে, যাঁরা জ্ঞানত স্বাধীনতার স্বাদ পাননি কৈশোরে। ফলে ইউরোপের মধ্যে দাঁড়িয়েও সাম্য, সমাজবাদ শব্দগুলো যে বিশেষভাবে আকর্ষিত করবে সেই প্রজন্মকে— তাতে আর আশ্চর্য কী! ফলে কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় মার্ক্সবাদী দর্শন, কমিউনিজমের পাঠ, সাহিত্যসাধনা।
১৯৪৭ সাল। চেক কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন মিলান। তার ঠিক পরের বছরই চেকোস্লোভাকিয়ায় স্থাপিত হয় কমিউনিস্ট সরকার। অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম সক্রিয় সদস্য হলেও, শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালে পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি।
পেশাগতভাবে সাহিত্যকে বেছে নেওয়া এইসময়েই। ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘ম্যান : আ ওয়াইড গার্ডেন’। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য লাস্ট মে’ উৎসর্গ করেন নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়া কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব জুলিয়াস ফুচিককে। অবশ্য ততদিনে সোভিয়েতের বিস্তারবাদী মনোভাব নিয়েও ক্রমশ ক্ষোভ জন্মেছে তাঁর মনে। ১৯৫৬ সালে সোভিয়েতে নিঃস্তালিনিকরণ শুরু হলে ফের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। শুরু করেন প্রচার। বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের চাকার তলায় যে পিষে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ, বন্ধ হচ্ছে তাদের কণ্ঠস্বর— সেই ছবি ব্যাঞ্জনার মাধ্যমে তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে তুলে এনেছিলেন মিলান।
অবশ্য এবারেও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেননি তিনি। বা বলা ভালো, নরমপন্থী কমিউনিস্টদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতই তাঁকে ‘গৃহশত্রু’ করে তোলে উগ্র রাজনীতিবিদদের চোখে। ১৯৬৮ সালে প্রাগের রাস্তায় নামে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক। কুন্দেরা সে-সময়ই প্রতিবাদ করে লিখেছিলেন, নিজেকে উগ্র রাজনৈতিক জগতে আটকে পড়া ভোগবাদী বলেই মনে করেন তিনি। এই মানসিকতার জেরে ফের কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাঁর সদস্যপদ। হারান চেক নাগরিকত্বও। এমনকি পরিস্থিতির চাপে ১৯৭৫ সালে স্ত্রী ভেরাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ফ্রান্সে। পরবর্তীতে চেক নাগরিকতা ফিরে পেলেও, ফ্রান্সকেই নিজের দেশ বলে মনে করতেন তিনি। নিজের পরিচয় দিতেন ফরাসি হিসাবে।
এমনকি ফ্রান্সে যাওয়ার পর মাতৃভাষার পরিবর্তে লেখার মাধ্যম হিসাবেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন ফরাসি ভাষাকেই। যদিও ফ্রান্সে বসতি স্থাপনের বেশ কয়েকবছর আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’। তবে স্তালিনের সমালোচনা করার জন্য সে-বই সেভাবে সমাদৃত হয়নি চেকোস্লোভাকিয়ায়। বলতে গেলে, মিলান কুন্দেরা বিশ্ববন্দিত হয়ে ওঠেন ফরাসি সাহিত্য জগতে পা রাখার পরেই। ফরাসি ভাষায় লিখিত ‘লাইফ ইজ এলসহোয়ার’ বইটির সৌজন্যে। এই গোটা উপন্যাসে তাঁর মুক্তচেতনার সঙ্গে যেন লড়াই চলেছে কমিউনিস্ট সত্তার।
এর পর আর পিছনে ফিরে তাকতে হয়নি মিলানকে। ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’, ‘ইমমর্টালিটি’, ‘ইগনোরেন্স’, ‘আইডেনটিটি’-র মতো কালজয়ী লেখা এসেছে তাঁর কলমে। তাঁর উপন্যাস অনূদিত হয়েছে একাধিক ভাষায়। তাঁর কাহিনি অবলম্বনে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। অবশ্য এইসকল সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে তিনি যে পাঠকমহলের কাছে কোনো বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন, এমনটা নয়। বরং, উপস্থাপন করেছিলেন নিজের দর্শনটুকু। নীরবে লড়াই করেছেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। মিলান প্রকাশ্যে স্বীকারও করেছিলেন রেনেসাঁসের লেখক সার্ভান্তেজ, বোকাচ্চিও কিংবা রেবালাইয়ের অনুপ্রেরণাই বার বার প্রভাবিত করেছে তাঁর লেখাকে। এমনকি তাঁর দাবি ছিল, তিনিই তাঁদের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন বিশ শতকে দাঁড়িয়ে।
আশির দশকের পর বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম কিংবদন্তি হয়ে উঠলেও, সেভাবে কোনোদিনই প্রকাশ্যে আসেননি মিলান। বরং আত্মনির্বাসন দিন কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। গোটা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে। অভিমত ছিল, সাহিত্যেকের একমাত্র কাজ লেখা, লেখার মাধ্যমেই কেবলমাত্র নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার অধিকার আছে তাঁর, সাক্ষাৎকার দেওয়া তাঁর ধর্ম নয়। অথচ, তাতেও যে বিতর্কে জড়াননি তিনি এমনটা নয়। ২০০৮ সালে অভিযোগ ওঠে তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের পতনের জন্য চরবৃত্তি করেছিলেন। ২০১১ সালেও তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছিল একইরকমের আইনভঙ্গের অভিযোগ। অবশ্য প্রতিবারই কলমের মাধ্যমে সে-অভিযোগ খণ্ডন করেছেন জেরুজালেম, মেদিচি, ফ্রানৎস কাফকা পুরস্কার-জয়ী লেখক। অবশ্য বেস্ট-সেলার লেখক, একাধিকবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়ার পরেও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি নোবেল পদক। কুন্দেরা-ভক্তদের একাংশের মতে এই ঘটনার পিছনেও জড়িয়ে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক অভিসন্ধি। যদিও তা নিয়ে প্রচারবিমুখ কুন্দেরার নিজের কোনো বক্তব্য, অভিযোগ, ক্ষোভ ছিল না কোনোকালেই। ‘To be a writer does not mean to preach a truth, it means to discover a truth’— যাঁর কলমে জন্ম নিয়ে এমন বাক্য, তাঁর দর্শনের কাছে আদতে ম্লান হয়ে যায় পদকজয়ের গৌরবও। দেখতে গেলে, সকলের আড়ালে আজীবন যেন তেমনই এক সত্যের অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন তিনি। বিশ শতক তো বটেই, একুশ শতকে দাঁড়িয়েও বপন করেছেন ভিন্নতর এক নবজাগরণের বীজ। তাঁর প্রয়াণে শূন্যস্থান প্রকট হল সেই সিংহাসন-জুড়ে…
Powered by Froala Editor