চেয়েছিলেন নৃবিজ্ঞানী হতে, পরিচালনায় এসে বদলে দিলেন চলচ্চিত্রের পৃথিবীটাই

‘ফিল্ম ইজ দ্য ট্রুথ টোয়েন্টি ফোর টাইম ইন আ সেকেন্ড অ্যান্ড এভরি কাট ইজ আ লাই’। 

সিনেমা-সত্যকে এভাবেই তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন আজীবন। বার বার ভেঙেছেন চলচ্চিত্রের রুল-বুক। সন্ধান করেছেন নতুন ব্যাকরণের। তাঁর কথায়, শ্যুটিং নয়, বরং এডিটিং-এই লুকিয়ে রয়েছে মন্তাজের রহস্য। এডিটিং-এর দৌলতেই বাস্তবকে উপস্থাপন করা যায় এক অন্য চেহারায়। 

কথা হচ্ছে ষাটের দশকের ফরাসি চলচ্চিত্রের ‘নিউ ওয়েভ’-এর (New Wave) জনক তথা কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ-লুক গোদারকে (Jean-Luc Godard) নিয়েই। বিগত বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন তিনি। মঙ্গলবার ৯১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আধুনিক চলচ্চিত্রের অন্যতম নক্ষত্র।  

১৯৩০-এর ডিসেম্বরে গোদারের জন্ম ফ্রান্সে প্যারিস শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। তবে মাত্র চার বছর বয়সেই দেশ ছাড়তে হয় তাঁকে। সে-সময় রাজনৈতিক জটিলতা প্রকট হচ্ছে গোটা ইউরোপ-জুড়ে। নাৎসি জার্মানির সঙ্গে ফ্রান্সের সংঘর্ষের সম্ভাবনাও বাড়ছে ক্রমশ। নিরাপত্তার জন্যই সপরিবারে সপরিবারে সুইজারল্যান্ডে চলে আসেন তাঁর বাবা, চিকিৎসক পল গোদার। সেখানেই বেড়ে ওঠা জঁ-লুকের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নাতকস্তরের পড়াশোনা করতে আবার প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। স্বপ্ন ছিল, একদিন নৃবিজ্ঞানী হয়ে উঠবেন তিনি। তবে স্নাতক ডিগ্রিলাভ অধরাই থেকে যায় তাঁর। বরং, তাঁকে নতুন করে আকর্ষণ করে এথনোলজি অর্থাৎ জাতিতত্ত্ব। তাঁর কথায়, জাতিতত্ত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়েই সিনেমার দুনিয়ায় হাজির হওয়া তাঁর। 

আরও পড়ুন
চলচ্চিত্রের পর্দায় রূঢ় বাস্তব, জাতীয় পুরস্কার রত্নাবলী রায় প্রযোজিত ‘থ্রি সিস্টারস’-এর

সেটা পঞ্চাশের দশকের একদম শুরুর দিক। প্যারিসজুড়ে তখন গড়ে উঠেছে বহু সিনে-ক্লাব। ১৯৫০ সালে তেমনই এক সিনেমা ক্লাবে ফ্রাঁসোয়া ট্রুফো এবং ক্লদ চ্যাব্রোলের সঙ্গে পরিচয় হয় গোদারের। তবে বাকি দুই কিংবদন্তির মতো চলচ্চিত্র-পোকা ছিলেন না গোদার। বা, বলতে গেলে প্যারিসে এসেই চলচ্চিত্রচর্চা ও দেখার অভ্যাস গড়ে ওঠে তাঁর। সেখান থেকেই চলচ্চিত্র সমালোচকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন গোদার। ‘কাহিয়ে দু’ পত্রিকায় সে-সময় প্রকাশ পেতে শুরু করে তাঁর লেখা বেশ কিছু চলচ্চিত্র সমালোচনা। তবে সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি গোদার। ধীরে ধীরে সিনেমা ভাবনা ও পরীক্ষামূলক নির্মাণ নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেন তিনি।

আরও পড়ুন
জামাই ঠকাতেই আবিষ্কার জলভরা সন্দেশের, প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্রও ‘জামাইষষ্ঠী’

অবশ্য যে-সময়ের কথা হচ্ছে, তখনও পর্যন্ত নিজে কোনো চলচ্চিত্র তৈরি করে উঠতে পারেননি তিনি। এমনকি হাত দেননি ক্যামেরাতেও। তার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় আরও বছর তিনেক। ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ডে বেশ কিছুদিনের জন্য মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান গোদার। সাময়িকভাবে জেনেভার গ্র্যান্ড ডিকেন্স বাঁধে শ্রমিক হিসাবে কাজ নেন তিনি। আসলে উপার্জন নয়, বরং নির্মাণ শ্রমিকদের বিচিত্র জীবনই আকর্ষণ করেছিল তাঁকে। ধার করা ক্যামেরায় তিনি ফ্রেমবন্দি করে বাঁধ নির্মাণের এই দৃশ্য। ‘অপারেশন বেটন’-খ্যাত সেই স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রেরই হাত ধরেই তাঁর আত্মপ্রকাশ সিনেমাজগতে। পরবর্তীতে নির্মাণ কোম্পানি সেই তথ্যচিত্রটি ব্যবহার করে প্রচারের কাজে। 

আরও পড়ুন
বন্ধ্যা সময় ও মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র

আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ময়দানে নামার আগে ‘অপারেশন বেটন’ ছাড়াও আরও তিনটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন গোদার। তাঁর লক্ষ ছিল, জার্মান নাট্যকার বার্টোল্ট ব্রেখটের থিয়েটারের ভাষাকে চলচ্চিত্রের রূপ দেওয়া। প্রতিটি তথ্যচিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেই প্রাকৃতিক আলো কিংবা তাৎক্ষনিক সংলাপে বিশেষভাবে জোর দেন গোদার। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে প্রথম ফিচার ফিল্মের প্রস্তুতিও। ১৯৬০ সাল। বড়ো পর্দায় মুক্তি পেল  ফ্রাঙ্কোইস ট্রুফো প্রযোজিত তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘ব্রেথলেস’। এই ছবিকে তাঁর চলচ্চিত্র ক্যারিয়ারের টার্নিং বলা চলে। 

এর পর একে একে মুক্তি পায় ‘আ উইম্যান ইস আ ইউম্যান’, ‘মাই লাইফ টু লিভ’, ‘দ্য লিটল সোলজার’-এর মতো কালজয়ী সিনেমা। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭-এর মধ্যে প্রায় এক ডজন ভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সিনেমার ব্যাকরণকে ছিন্নভিন্ন করেছেন গোদার। প্রশস্ত করেছেন ‘নিউ ওয়েভ’-এর যাত্রাপথ। তৈরি করেন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের এক নতুন ন্যারেটিভ। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইহুদি বিদ্বেষ কিংবা ভোগবাদ ও বুর্জোয়া সমাজের সমালোচনা— গোদারের চলচ্চিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে প্রতিটি আঙ্গিকই। অবশ্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী যেভাবে ইতিহাসকে দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছে, তা নিয়ে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর। 

সবমিলিয়ে প্রায় ৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন জঁ-লুক গোদার। নিজের ছবির মধ্যে দিয়েই কখনও প্রতিষ্ঠিত করেছেন সিনেমার ভাষা আবার কখনও ঘোষণা করেছেন চলচ্চিত্রের মৃত্যুর কথাও। শেষ জীবনেও অক্লান্তভাবেই চালিয়ে গেছেন ভাঙা-গড়ার এই খেলা। ২০১৮ সালে মুক্তি পায় তাঁর শেষ চলচ্চিত্র ‘দ্য ইমেজ বুক’। তবে আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে আগাম জানিয়ে রেখেছিলেন ‘তরুণ’ পরিচালক। কিন্তু সে-ছবি আর দেখার সৌভাগ্য হল না দর্শকদের। তার আগেই অন্য এক দুনিয়ায় পাড়ি দিলেন কালজয়ী গোদার। সেইসঙ্গে ইতি পড়ল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের এক বর্ণময় অধ্যায়ে…

Powered by Froala Editor