প্রয়াত বিজ্ঞানী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পরমাণু-গবেষণার জগতে শূন্যতা

মারটেনসিটিক ট্রান্সফর্মেশন। পদার্থের এমনই এক বিশেষ অবস্থা, যেখানে অণুর অবস্থান পরিবর্তন ছাড়াই সম্ভব কেলাস গঠন বা স্ফটিকীকরণ। এই বিশেষ ধরনের অবস্থার পরিবর্তন নিয়েই দীর্ঘ গবেষণা তাঁর। মূলত জার্কোনিয়াম ধাতু ও তার সংকর ধাতুর মধ্যেই এই বিশেষ অবস্থা সর্বপ্রথম তৈরি করে দেখিয়েছিলেন তিনিই। ‘ব্যানার্জি’স থিসিস’ নামে পরিচিত সেই গবেষণাপত্র কয়েক দশক পেরিয়ে এসে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক সলিড স্টেট পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতে পরমাণু গবেষণার অন্যতম মুখ তিনি। এবার কোভিড কেড়ে নিল তাঁকেও। 

গতকাল নবি মুম্বাইয়ে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মাস খানেক আগেই করোনাজয় করে ফিরেছিলেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে কে-ই বা জানত পোস্ট-কোভিড হৃদরোগে হঠাৎ থেমে যেমন এমন প্রাণবন্ত একটি মানুষের স্পন্দন? বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। 

মুম্বাইতেই জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেও ১৯৪৬ সালে উত্তর কলকাতায় জন্ম শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বেড়ে ওঠা সেখানেই। খড়গপুর আইআইটি থেকে ১৯৬৭ সালে ধাতু সংক্রান্ত প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতক সম্পূর্ণ করেন তিনি। ওই একই বছরে তিনি দায়িত্ব পান ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে। মেটালার্জি ডিভিশনের সায়েন্টিফিক অফিসার হিসাবে শুরু করেন কর্মজীবন। তবে এর সঙ্গে সমান তালেই চলেছে গবেষণা। ১৯৭৪ সালে খড়গপুর আইআইটি থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। অধ্যাপনার জগতে প্রবেশ তার পরেই।

তবে ধাতুবিদ্যা ছাড়াও পারমাণবিক শক্তি নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন তিনি। সংকর ধাতুর বিচ্ছিন্নকরণ, বিকিরণ বর্ণালি, স্ফটিকীকরণ এবং মেটাস্টেবল ফেজের গবেষণায় রয়েছে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। সব মিলিয়ে ৩০০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকি সলিড স্টেট পদার্থবিদ্যায় গবেষণারত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তাঁর লেখা ‘ফেজ ট্রান্সফর্মেশন’ বইটি প্রামাণ্য বই বলেই ধরে নেওয়া হয়। হোমি ভাবা রিসার্চ সেন্টার ছাড়াও ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়, সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়, সাসেক্স, ব্রাইটন এবং ম্যাক্স-প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটেও দীর্ঘদিন অতিথি অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। 

আরও পড়ুন
সিঙ্গাপুর স্ট্রেনেই তৃতীয় তরঙ্গ ভারতে, আশঙ্কায় ত্রস্ত গবেষকরা

অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি সামলেছেন ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদ। ছিলেন হোমি ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারের অধিকর্তা। ২০১৮ সালে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন তিনি। 

আরও পড়ুন
সার্বিক অনাক্রম্যতা অর্জন অসম্ভব, কোভিড নিয়ে আশঙ্কা গবেষকদের

তবে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো ছাড়া যে বিজ্ঞানের প্রসার অসম্ভব— তা বার বার উঠে এসেছে তাঁর কথায়। নিজেও নিয়েছেন একাধিক উদ্যোগ। ভাবা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা থাকাকালীন ২০১২ সালে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরমাণু গবেষণার বিশেষ শাখা তৈরি করেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক চান্সেলরের পদেরও দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। 

আরও পড়ুন
‘করোনা চিনের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাতিয়ার’, গোপন নথি প্রকাশ করে দাবি চিনা গবেষকের

২০০৫ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে ভারত সরকার। ১৯৮৯ সালে পেয়েছিলেন শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার। তাছাড়াও অক্টামেটালার্জিকা, হামবোল্ট, মেটিরিয়াল সায়েন্স প্রাইজ-সহ একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মাননাও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। 

অধ্যাপনা থেকে সরে আসার পরেও ছাত্র-ছাত্রী এবং তরুণ গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়নি তাঁর। একেবারে শেষ বয়স পর্যন্ত নিয়মিতই হাজির হতেন গবেষণাগারে। বর্তমানে সব মিলিয়ে ১০ জন রিসার্চ স্কলারের উপদেষ্টা হিসাবেই তিনি কাজ করছিলেন ভাবা রিসার্চ সেন্টারে। ছিলেন পরমাণু শক্তি কমিশনের অভিভাবকও। এমন ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে বিরাট এক শূন্যস্থান তৈরি হল ভারতের বিজ্ঞানমহলে। যে ক্ষতি অপূরণীয়…

Powered by Froala Editor

Latest News See More