১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। জাপানের সাধারণ একটি শহর হিরোশিমা। অন্যান্য দিনগুলোর মতোই চলছিল জীবনযাপন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়া, একটু তো আতঙ্ক থাকবেই। আকাশে বেশ কিছুক্ষণ ধরে একটা প্লেন চক্কর কাটছে। এক সময় প্লেনটা তীব্র গতিতে চলে গেল দূরে। নিচে কিছু একটা নেমে আসছে। বাকিটা মনে নেই কারোর। ১৯৪৫, ৬ আগস্ট। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম কালো একটি দিন। বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমার অভিঘাত সহ্য করতে হয়েছিল হিরোশিমাকে। তার ঠিক তিনদিন পর, নাগাসাকি। কয়েক লাখ মানুষ চোখের নিমেষে ছাই হয়ে গেল। চারিদিকে ছিল শুধু কালো, বিষাক্ত ফাঁকা জায়গা…
ইতিহাসের পাতায় বহুবার উঠে এসেছে সেই ছবি। ব্যাঙের ছাতার মতো উঠে যাচ্ছে বিস্ফোরণের ধোঁয়া— বিশ্বযুদ্ধের নিয়তি যেন সেই ছবিতেই লুকিয়ে ছিল। হিরোশিমা আর নাগাসাকি— দুটো শহরেই ছড়িয়ে পড়েছিল মৃত্যুর আওয়াজ। সেখান থেকেই বেঁচে উঠেছিলেন কয়েকজন। তেজস্ক্রিয় বিকিরণে অনেকের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়েছিল; এমনকি পরবর্তী প্রজন্মও ভুক্তভোগী। সেসবই দেখছেন তেরুকো উয়েনো, এমিকো ওকাডারা। সেই বীভৎস অবস্থা থেকে এই মহিলারা বেঁচে ফিরেছিলেন। জীবন কাটাচ্ছেন বটে; কিন্তু ১৯৪৫ কি বেরিয়েছে জীবন থেকে?
হিরোশিমা রেড ক্রস হাসপাতালের নার্সিং স্কুলের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী ছিলেন তেরুকো। মাত্র ১৫ বছর বয়স তাঁর। চোখ-মুখে তখন সদ্য ফুটে ওঠা তারুণ্যের উজ্জ্বলতা। বুঝতেই পারেননি এমনটা হবে। যখন বোমা পড়ল, কী যে হল কিছুই বোঝা গেল না। সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। একটু ধাতস্থ হতেই তেরুকো দেখলেন, হাসপাতাল জ্বলছে। চারিদিকে তাঁর বন্ধুদের মৃতদেহ। বাকিদের বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তিনি। খাবার নেই, জল নেই। সেই অবস্থায় বাকিদের সেবা শুশ্রূষা করেছেন। পরে স্কিন ট্রিটমেন্ট করেছেন। তাঁর স্বামীও হিরোশিমার পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আজ মেয়ে, নাতনি নিয়ে সুখের সংসার তেরুকোর।
এমনই অনেক স্মৃতি এমিকো ওকাডার। সত্যিই কি স্মৃতি বলে আছে কিছু? হিরোশিমার ঘটনাটা ঘটার সময় তাঁর বয়স মাত্র আট। কতটাই বা জানতেন পৃথিবীকে!। এমিকোর একটা পরিবার ছিল, একটি বোন ছিল- মিইকো। পারমাণবিক বিস্ফোরণে তাঁরা সবাই মারা যান। তাঁদের শরীরটুকুও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমিকোর মা সেই সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত মৃত সন্তান প্রসব করেন। এমিকো একা নন; হাজার হাজার মানুষের তখন এই একই পরিণতি। কোনো খাবার নেই, কিচ্ছু নেই। তেজস্ক্রিয় বিষ ছড়িয়ে আছে সব জায়গায়। আঁকড়ে ধরে আছে দুটো শহরকে। হঠাৎই এমিকোর চুল পড়তে আরম্ভ করল, মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে শুরু করল। ডাক্তার বলল, অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়া। আজও সেই বিষ নিয়ে ঘুরছেন তিনি। প্রচার চালাচ্ছেন যাতে এমন দুর্দশা আর কারোর না হয়। কেউ কি শুনবে এঁদের কথা?
৯ আগস্টের নাগাসাকিও একই ধ্বংসলীলা দেখেছিল। সেখানেই থাকত রেইকো হাদা। মাত্র নয় বছর বয়স তখন। এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেদিনের কথা। সকাল সকাল সেনাবাহিনীর ঘোষণা, যুদ্ধবিমান আসছে। সবাই ঘরে চলে যাও। সেইমতো ঘরে এসে বসেছিলেন ছোট্ট রেইকো। হঠাৎ চোখের সামনে আলোর বন্যা। এত আলো আগে দেখেননি তিনি। তারপরই বীভৎস আওয়াজ। সৌভাগ্যক্রমে, রেইকোর গায়ে একটা আঁচড়ও পড়েনি। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে যে দৃশ্য দেখেন, তা জীবনে ভুলতে পারবেন না। লোকজন দৌড়চ্ছে রাস্তা দিয়ে। জামা নেই, জুতো নেই; চামড়ার প্রায় অনেকটাই পুড়ে গেছে। কারোর মাথার ওপরের অংশটুকু পুড়ে বীভৎস হয়ে আছে, কারোর চোখ বেরিয়ে আছে…! আর যেদিকে তাকানো যায় শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস। যারা আসছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই জল খেতে চাইছিলেন। আর অদ্ভুত ঘটনা, জল খাওয়ার পরেই এক এক করে সবাই মারা যাচ্ছিলেন। আর সেই সমস্ত কিছু দেখছিলেন নয় বছরের রেইকো হাদা।
এরপরও পারমাণবিক আস্ফালন দেখিয়ে যাবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের হুংকারে আমরাও যুদ্ধের কথা তুলব। সবাই বলব পরমাণু বোমা চালাও। কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি, হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পড়া বোমার থেকে হাজার গুণ শক্তিশালী বোমা এখন তৈরি হয়েছে। তার একটাও যদি নিক্ষেপ করা হয়, কী তাণ্ডব ঘটবে? যে মানুষগুলো নিজের চোখে ধ্বংস দেখেছেন, তাঁরা জানেন আসল কষ্ট। যুদ্ধ থামিয়ে শান্তির প্রচার করাটা কি খুব কঠিন কাজ? আসুন না, সবাই মিলে হাত বাড়াই! যুদ্ধ নয়; বিজ্ঞান হয়ে উঠুক শান্তি ও পরিবেশ রক্ষার হাতিয়ার।
আরও পড়ুন
পরমাণু বিস্ফোরণের ধাক্কা সামলেও বেঁচে আছে হিরোশিমার ১৭০টি গাছ
ঋণ - বিবিসি
Powered by Froala Editor