১৯২৩ সাল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Bibhutibhusan Bandyopadhyay) তখন একপ্রকার বেকার। এর আগে কিছুদিন কাজ করেছেন হরিণাভির একটি স্কুলে। সেই সময় পরলোকগমন গমন করেন তাঁর মা মৃণালিনী দেবী। বছর কয়েক আগে মারা গেছেন প্রথম স্ত্রী গৌরী দেবী। বাংলার গ্রাম-প্রকৃতির সঙ্গে যে মানুষটির অন্তরাত্মার যোগাযোগ, তিনি যেন এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচেন। বছর দেড়েক কাজ করলেন ব্যবসায়ী কেশোরামজির অধীনে। পূর্ববঙ্গ ও বর্তমান মায়ানমারের বিস্তৃত অঞ্চলে ঘুরতে হয় কাজের সূত্রে। মন ভরেনি এই কাজে, ফিরে এলেন কলকাতায়। এর কিছুদিন পর অমৃতবাজার পত্রিকায় চোখে পড়ে একটি বিজ্ঞাপন— ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি চাই’। বিজ্ঞাপনদাতা পাথুরিয়াঘাটার ধনী ব্যক্তি অক্ষয় ঘোষ। বিভূতিভূষণ জানতেন, এই পদে তাঁর প্রতিযোগিতা হবে অনেক আইনজীবীর সঙ্গে। তবু গেলেন তিনি, দরখাস্তে উল্লেখ করলেন তাঁর ‘সাহিত্যিক’ পরিচয়।
তখনও অবশ্য ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশিত হয়নি। সেটা অনেক পরে, ১৯২৯ সালে। কিন্তু ‘প্রবাসী’-তে কয়েকটি ছোটোগল্প ইতিমধ্যেই বেরিয়েছে। ‘বিখ্যাত’ না হয়ে উঠলেও পাঠকমহলে প্রশংসা পাচ্ছে তাঁর লেখা। কিছুটা সেই সুবাদেই পেয়ে যান চাকরিটি। সঙ্গে ছিল তাঁর সততা ও ঐকান্তিকতা। ১৯২৪-এ তাঁকে অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার করে পাঠানো হয় পাথুরিয়াঘাটা জমিদারির ভাগলপুরের বিরাট এস্টেট-এর দেখভাল করার জন্য। এখানে এসে যেন প্রকৃত শান্তি খুঁজে পেলেন। কলকাতা শহর, বন্ধুবান্ধব, স্বজন হারানোর স্মৃতি সব পিছনে ফেলে একাত্ম হয়ে গেলেন পাহাড়ি বনস্থলি ভাসানো পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়। ১৯২৪ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত এখানে কাজ করেছিলেন বিভূতিভূষণ। সেখানের মানুষ, অরণ্য, নাম না জানা ফুলের দল, ঘোড়ায় চড়ে একা একা রাত্রিভ্রমণের অভিজ্ঞতা ভিড় করে এল লেখায়। ১৯৩৯-এ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেল তাঁর উপন্যাস— ‘আরণ্যক’ (Aranyak)।
যদিও উপন্যাসের স্মৃতির পাতার শেষ অংশ বেদনার, অপরাধের ভার লাঘব করার জন্য উপন্যাসের মূল চরিত্র সত্যচরণ লিখতে বসেছিল এই কাহিনি। মনে করে দেখা যাক ‘আরণ্যক’-এর সূত্রপাতের কয়েকটি বাক্য,
“ইহাদের কথাই বলিব। জগতের যে পথে সভ্য মানুষের চলাচল কম, কত অদ্ভুত জীবনধারার স্রোত আপন মনে উপলাকীর্ণ অজানা নদীখাত দিয়া ঝিরঝির করিয়া বহিয়া চলে সে পথে, তাহাদের সহিত পরিচয়ের স্মৃতি আজও ভুলিতে পারি নাই।”
বাস্তবে বিভূতিভূষণ নির্জন অরণ্যপ্রান্তর থেকে পেয়েছিলেন মানুষ ও জীবনকে চিনবার নতুন শিক্ষা। ইসমাইলপুর, লবটুলিয়া, আজমাবাদের মতো অঞ্চলগুলির অসংখ্য নিঃস্ব-রিক্ত মানুষরা পূর্ণ করেছিল তাঁর অন্তরের শূন্যস্থানকে। আর এই নির্জন প্রবাসে বসেই প্রস্তুতি চলেছিল পরবর্তী উপন্যাসগুলির।
আসলে ‘আরণ্যক’ পড়লেই বোঝা যায়, উপন্যাসের মতো আদি-মধ্য-অন্ত্য যুক্ত কাহিনি এখানে অনুপস্থিত। বিজন অরণ্যের বিস্তৃতির মধ্যে লেগে রয়েছে শুধু মানুষের চলাচল। সরে যায় সত্যচরণ, নায়ক হয়ে ওঠে ‘সভ্য’ মানুষের স্পর্শবিহীন ভাগলপুরের পাহাড়িয়া পটভূমি। মটুকনাথ, রাজু পাঁড়ে, যুগলপ্রসাদ, ধাওতাল সাহু, কুন্তা, মঞ্চী-রা বিভূতিভূষণের অন্তঃস্থলের অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে এসে দাবি করে উপন্যাসের আসল মালিকানা। উপন্যাসের সেই জ্যোৎস্না রাত্রে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা যেন তাঁর ডায়েরির পাতা থেকে তুলে নেওয়া,
“মাথার উপরের নক্ষত্রজগতের দিকে চেয়ে দেখলাম, এই জীবন ঐ পর্যন্ত বিস্তৃত। কত এরকম জ্যোৎস্না রাত্রি, কত এরকম যাওয়া আসা, কত জীবনানন্দ।”
আরও পড়ুন
বিভূতিভূষণের ‘মেঘমল্লার’ ও সরস্বতী-প্রসঙ্গ
জীবনের ছোটো-বড়ো সুখস্মৃতির মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার যে রূপ তাঁর সাহিত্যে পাওয়া যায়, ভাগলপুরের অরণ্যে যেন হাতেখড়ি হল তার। আবার শক্ত হাতে সামলেছেন দাঙ্গাও। আপনহাতে সাজান কমলাকুণ্ডকে, অনেকটা ‘আরণ্যক’-এর সরস্বতী কুণ্ডের মতোই। নিজের ভিতর থেকে জাগিয়ে তোলেন যুগলপ্রসাদকে। এরকমই একদিন ফিরে আসছেন কমলাকুণ্ড থেকে। ফুলকিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে কলবলিয়া-তে নামলেন স্নান করতে। শীতল জলে শরীর ভেজাতেই মনে পড়ে গেল ইছামতীর কথা, নিজের দেশের কথা। স্নিগ্ধ নদীর দু-পাশের ঝোঁপে ফুটে আছে বনকুসুম, ফুলে ভরা ঘেঁটুবনের সারি। দূরের ওই গাছটাতে একটা গাঙ-শালিকের বাসা আছে না? আকন্দ ফুলের গন্ধে উঠতে ইচ্ছে করে না নদী থেকে। যে শিশু আজ প্রথম এল নাইতে, হয়তো নদীর পারের ছাতিমবনের পাশ দিয়েই যাবে তার শেষযাত্রা। গত পাঁচশো বছর ধরে এভাবেই একা একা কথা বলছে নদীর ঘাট। ফিরতে হবে তাঁকে ইছামতীতে, গল্প লিখতে হবে এদের নিয়ে। এটা ১৯২৮ সালের ডায়েরির অংশ। তার ঠিক ২২ বছর পরে প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস— ‘ইছামতী’।
আরও পড়ুন
শপিং কমপ্লেক্সের কোপে বিভূতিভূষণের বাড়ি, নষ্টের পথে অপু ট্রিলজির পাণ্ডুলিপিও
আর ভানুমতী? তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে? গৌরী দেবীর মৃত্যুর পরের একাকিত্ব কি আদিম অরণ্যের আকর্ষণে কল্পনা রূপে ফিরে এল? বাস্তবে হয়তো কোনো অস্তিত্ব নেই ভানুমতীর। তবে দোবরু পান্নার রাজত্ব আছে, চিরকালই ছিল। আর্য-অনার্যের দ্বন্দ্বগাথা থেকে ঔপনিবেশিক ভারতের ধারাবাহিক ইতিহাসে উপেক্ষিত জনজাতি প্রতিনিধিরা। মনে পড়তে পারে আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বোমা থেকে বাঁচতে কলকাতা ছাড়ছে বহু মানুষ। ঝাড়গ্রামের গভীর বনাঞ্চলের মধ্যে একাই যাতায়াত করেন বিভূতিভূষণ। হঠাৎ ইচ্ছা হল, এখানে জমি কিনে থাকবেন। নিজেই বলছেন, “আমার একটা খারাপ অভ্যেস, যেখানে যত ভাল জায়গা দেখবো, সেখানেই আমার ইচ্ছা হবে বাড়ি তৈরি করি।” ভানুমতীর সঙ্গেও তো তাই ইচ্ছা ছিল। সত্যচরণের মধ্যে দিয়ে তিনিই যেন বলেছিলেন,
“এখানেই যদি থাকিতে পারিতাম! ভানুমতীকে বিবাহ করিতাম। এই মাটির ঘরে জ্যোৎস্না-ওঠা দাওয়ায় সরলা বন্যবালা রাঁধিতে রাঁধিতে এমনি করিয়া ছেলেমানুষী গল্প করিত—আমি বসিয়া শুনিতাম।”
সে আশা বাস্তব হয়নি। পিছু টেনেছিল কর্তব্য, কলকাতা আর আর্য-সত্তা। বাস্তবেও পারেননি অর্থাভাবের জন্য। সব স্বপ্ন সত্যি হলে তো মিলেমিশে যেত সত্যচরণ আর বিভূতিভূষণ। ‘আরণ্যক’-এর কাহিনি রয়ে যেত ভাগলপুরেই। দেখা মিলত না ইছামতীর তীরে ভেসে আসা পুরনো জাহাজ কিংবা নিশ্চিন্তিপুরের কাশফুলের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ট্রেনের ছুটে যাওয়ার মুহূর্ত। কিছু স্বপ্ন হয়তো পূরণ না হওয়াই ভালো!
Powered by Froala Editor