"কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কী যেন ভাবল। তার পর বলল, "সাত দুগুণে চোদ্দোর নামে চার, হাতে রইল পেনসিল"। সুকুমার রায়ের "হ য ব র ল" র কাক্কেশ্বর ঠিক কোন কোম্পানির পেনসিলে অঙ্ক কষেছিল তা হয় তো আমাদের জানা নেই, কিন্তু পেনসিল বলতে বাঙালির স্মৃতিতে চিরকালীন অভ্যেস তৈরি করেছে সেই লাল-কালো খোলসের নটরাজ পেন্সিল আর ছাইরঙা অপ্সরা পেনসিল। একথা সবাই বেশ জানে।
শুধু নাম আর খোলসই নয়, নটরাজ বা অপ্সরার বিজ্ঞাপনও ক্রেতাদের কাছে অভিনবত্ব তৈরি করেছে। একদিকে নব্বই-এর দশকের সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনে আর পাঁচটা পেনসিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দৌড়ে নটরাজ পেনসিল অনায়াসে জিতে গিয়েছে। অন্যদিকে অপ্সরার 'একস্ট্রা ডার্ক' পেনসিল পরীক্ষার খাতায় একস্ট্রা মার্কস এনে দিয়েছে। সেই থেকে আজ অবধি দীর্ঘ ৬২ বছরের যাত্রাপথে 'নটরাজ' আর 'অপ্সরা' আমাদের শৈশবের নস্টালজিয়া হয়ে থেকে গিয়েছে।
১৫৬০ সালে ইতালিয়ান দম্পতির তৈরি কাঠের ফ্রেমবন্দি গ্রাফাইট দিয়েই পেনসিলের যাত্রাপথের সূচনা হয়েছিল। ভারতে প্রথম পেন্সিল তৈরি শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। 'হিন্দুস্তান পেনসিলস্ প্রাইভেট লিমিটেড'-র হাত ধরে। 'নটরাজ' ব্র্যান্ডের নাম নিয়ে প্রথম পেনসিল তৈরি শুরু করে এই কোম্পানি। প্রথমদিকে পেনসিলের পাশাপাশি ইরেজার আর পেনসিল কাটার তৈরিও শুরু হয়। পরবর্তীকালে ১৯৭০ সালে 'অপ্সরা' নামক ব্র্যান্ড নিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা। অপ্সরাই ভারতে প্রথম নন-ডাস্ট ইরেজার নিয়ে আসে। তারও বেশ কিছুদিন পর, ২০০৭ সালে এই হিন্দুস্তান কোম্পানি নটরাজ পেন্সিলের খোলসের জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে, একই আদলে তৈরি করে নটরাজ পেন। এছাড়াও অপ্সরা ব্র্যান্ডেই প্রথম আসে ড্রইং পেনসিলের ধারণা। বাজারে বিক্রি হতে থাকে সবুজ খোলসের '2B', '4B', '8B' পেন্সিল। আজও আঁকার পেনসিলের বিকল্প হিসেবে অপ্সরার আশপাশে কারোর জায়গা হয়নি।
মুম্বাই শহরে প্রথম যাত্রা শুরু হয় হিন্দুস্তান পেনসিলস্ প্রাইভেট লিমিটেডের। বর্তমানে দেশের ৫টি জায়গায় ১০টি কারখানা রয়েছে এই কোম্পানির। এছাড়া এদেশের চাহিদার পাশাপাশি আরও প্রায় ৫০টি দেশে এই হিন্দুস্তান পেনসিলের প্রোডাক্ট রপ্তানি করা হয়। এখনো প্রতিদিন প্রায় ৮ মিলিয়ন পেন্সিল, ১.৫ মিলিয়ন কাটার, ২.৫ মিলিয়ন ইরেজার, ০.২ মিলিয়ন স্কেল, ১ মিলিয়ন পেন তৈরি হয় এই কোম্পানিতে, এমনটাই জানা যায় বিভিন্ন সূত্র থেকে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক তাগিদকে ধরে রাখতে পেনসিল, পেন, ইরেজার, পেনসিল কাটারে পাশাপাশি রুলার, গাণিতিক যন্ত্রপাতি, মেকানিকাল পেনসিল, কালার পেনসিল কিংবা মোম রং বা জল রং প্রস্তুত শুরু করে এই কোম্পানি। শুধু তাই নয় সময়ের সঙ্গে এসেছে একাধিক রঙের এবং গঠনের পেনসিল, ইরেজার। এসেছে একাধিক রঙের খোলস।
আরও পড়ুন
শরৎচন্দ্র ডাকতেন ‘গণিত-শিল্পী’ নামে, তাঁর অনুরোধেই বই লিখলেন কে সি নাগ
বর্তমানে শুধু পেনসিল নয়, একাধিক মাপের পেনসিলের সিসও আলাদা করে কিনতে পাওয়া যায়। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর যুগে দাঁড়িয়ে, কাঠের পেনসিল প্রস্তুতিতে গাছ কাটার বিকল্প হিসেবে এই কোম্পানি এক দৃষ্টান্তমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বন্যকাঠ ব্যবহারের কথা না ভেবে এই কোম্পানি নিজস্ব গাছ লাগিয়ে কাঠ কাটা এবং পাশাপাশি আবার নতুন গাছ লাগানো এই পদ্ধতিকেই অবলম্বন করে এসেছে। ফলে সহজেই রক্ষা করা গিয়েছে জীব বৈচিত্র্য। শুধু পেনসিল, পেন কিংবা যন্ত্রপাতি প্রস্তুতই নয়, পাশাপাশি একাধিক সামাজিক কাজেও যুক্ত থেকেছে হিন্দুস্তান পেনসিলস্ প্রাইভেট লিমিটেড। তৈরি করেছে নটরাজ এডুকেশনাল ট্রাস্ট। মেয়েদের স্কুল তৈরির পাশাপাশি সেরিব্রাল পলিসি, মানসিক ও শারীরিক ভাবে অক্ষম মানুষের ব্যবহারিক ও পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে এই কোম্পানি।
বর্তমানে এই পেপারলেস প্রযুক্তির যুগে যদি কারোর উপরে প্রবল আঘাত এসে থাকে, সে হল পেনসিল। একসময় লেখনীর সমস্ত দায়িত্বই একা হাতে সামলেছে পেনসিল, কিন্তু আজ আর তার তেমন কদর করে না কেউই। কেবল নতুন শিক্ষার্থীদের হাতে আর শিল্পীর ক্যানভাসে অথবা জীববিদ্যা বা ভূগোলের খাতায় স্কেচ করতে কিংবা বড়োজোর কাঠের কাজের সময় মাপ নিতে ডাক পড়ে তার। যদিও কম্পিউটারের যুগে বাঙালির জীবনে পেন্সিল আজ কতটা তা নিয়ে ভাববার অবকাশ প্রায় নেই বললেই চলে। তবুও ছেলেবেলার স্কুলব্যাগটা ঘাঁটলে নিশ্চয়ই সেই স্মৃতি আজও খানিকটা উস্কানি দিয়ে যায়। তাই আজও নতুন বইয়ের পাতায় দাগ দিতে আনাচে কানাচে হাতড়ে আমরা এক টুকরো পেনসিল খুঁজি। ছেলেবেলার সেই স্মৃতিতে আর অভ্যাসে বদল ঘটেনি আমাদের। বদল ঘটেনি পরিচিত ব্র্যান্ডেও। দোকানে পেনসিল কিনতে গেলে তাই আজও আমরা কেবল নটরাজ কিংবা অপ্সরাই খোঁজ করি। পরিচিত রং আর চিরকালীন অভ্যাস চারটাকা দামে দিব্যি কিনে আনি।
আরও পড়ুন
গড়গড়ার শব্দে চমকে দিয়েছিলেন সাহেবদের, বিস্মৃতির অতলে প্রথম বাঙালি বিলেতযাত্রী
Powered by Froala Editor