২৫ ছুঁতে-চলা পোকেমন, অ্যাশ-পিকাচুর খুনসুটি এবং ছেলেবেলার পাগলামির দিনগুলো

যদি বলি, 'পোকেমনে'র জন্ম পোকা থেকে? ভেবলে গেলেন? না মশাই। মজা করছি না। জাপানে, গ্রামের দস্যি খোকাখুকুরা পোকা ধরতে ভালোবাসে। গুবরে, মাকড়সা, বিছে, জোনাকি, তেলাপোকা। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ। কাঁচের বয়ামে জমিয়ে রাখা। মাঝে-মধ্যে লড়াইতে নামে পোকারা। প্রজাতি বনাম প্রজাতি। অনেকটা মোরগ লড়াইয়ের মতোই।

গুবরেদের এই যুদ্ধ দেখে গেম-ডেভলপার 'সাতোশি তাজিরি'র মাথায় ঝিলিক খেলে যায়। ছোট্টবেলা থেকে নিজেও সংগ্রহ করেছেন নানা রকম কীটপতঙ্গ। পাড়ার ছেলেমেয়েরা খেপাত 'পোকা-ডাক্তার' বলে। বিশ্বায়নের দোরগোড়ায়, মুছে যাচ্ছে গ্রাম, ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে ছেলেবেলার অনাবিল আনন্দ। দুপুর রোদে, ঝোপেঝাড়ে পোকা-ধরার মজা…

আরও পড়ুন
৮০ বছর অতিক্রান্ত, নির্বাক হয়েও আজও ‘নতুন’ টম অ্যান্ড জেরি

তখন বাজারে ঘুরছে নতুন 'গেম-কনসোল' 'গেম-বয়'। ছোটবেলার সেই 'অ্যাডভেঞ্চার’কেই শহুরে খোকাখুকুদের সামনে নতুন ভিডিও-গেমরূপে হাজির করলেন তাজিরি। ৬ বছর, রগড়ারগড়ির পর বাজারে এল 'পোকেমন রেড' আর 'পোকেমন গ্রিন'। ১৯৯৬ সালে।

'পোকেমন' অর্থাৎ 'পকেট মনস্টার'। সম্পূর্ণ নতুন একটা জগৎ। যেখানে মানুষের পাশে হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে, পোকেমন'। কিম্ভুত এক প্রাণীজগৎ। খানিক গতানুগতিক জন্তু-জানোয়ারদের আদলেই। পোষ মানানো যায়। ধরে রাখা যায় ছোট্ট পোকে-বলে। তারপর, বিভিন্ন টুর্নামেন্টে নিজেদের পোকেমনকে লড়াইয়ের ময়দানে নামায় ট্রেনার-রা। প্রত্যেকটি পোকেমনের ভয়ঙ্কর সব ক্ষমতা। কেউ মুখ থেকে আগুন ছোঁড়ে, কেউ বা শূন্যে উঠে ডানার ঝাপটায় ঘূর্ণিঝড়ে ঢেকে দেয় ময়দান। যাকগে… এদের নাম মনে রাখা বেশ শক্ত। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৮৯০টি পোকেমনের খবর দিয়েছে 'নিনটেন্ডো।' তারাই এখন পোকেমন-ফ্র্যাঞ্চাইজির সর্বস্বত্ব অধিকারী।

আরও পড়ুন
কার্টুনের লড়াই নেমে আসত ময়দানেও, বে-ব্লেড ও আমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা

আন্দাজ ২০০২-০৩ সালে ভারতের কার্টুন নেটওয়ারকে প্রথম এল আ্যশ কেচাম ও মিষ্টি পিকাচু-র কাণ্ডকারখানা। ইংরেজি ডাবিং-এ। তার আগেই টিভি-তোকিও প্রযোজিত সিরিজ বেরিয়ে গিয়েছে ১৯৯৭ সালে। পোকেমন ঝড়ে কাঁপছে জাপান। এবার গোটা দুনিয়ার পালা।

টিভি-র সেই বিখ্যাত গান "I want to be the very best…" এবং শেষে অবিস্মরণীয় 'ক্যাচফ্রেজ', "Gotta Catch'em all!" সম্প্রচার হওয়ামাত্রই সুপারহিট।

আরও পড়ুন
স্পাইডারম্যান হোক বা হাল্ক – শৈশবের ‘সুপারহিরো’দের জন্ম দিয়েছিলেন যিনি

তারপর 'জোহটো' থেকে 'কানটো' জল গড়িয়েছে অনেকদূর। ইস্কুল থেকে বাড়ি সর্বত্র পোকেমন আর পোকেমন। একগাদা সিনেমা, সিরিজ, খেলনা কত কী! বাজারচলতি ব্র্যান্ডগুলো বের করছে নিত্যনতুন 'ফ্রি-গিফট'। মনে আছে, চিপসের প্যাকেট খুললে পাওয়া যেত গোলাকার 'ট্যাজো'। বিরল 'জেঙ্গা'-কার্ড , 'ডায়মন্ড কার্ড', 'ট্রেডিং-কার্ড'-এর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি সবাই। সর্বত্র 'কেনাবেচা' চলছে। 'তিনটে বাজে পোকেমন'-এর জন্যে একটা ভালো 'পোকেমন'। ঝগড়াঝাঁটি-কান্নাকাটি।

"স্যার, ও আমার সবকটা কার্ড নিয়ে নিয়েছে…"

"তোকে আর দেবো না, আগেরবার ঠকিয়ে দিলি!"

আরও পড়ুন
কেউ বলেন ‘বুড়ির চুল’, কারোর কাছে ‘হাওয়াই মিঠাই’ – ১১৬ বছরেও অটুট নস্টালজিয়া

জুতোর বাক্স, পেন্সিল বাক্সে জমছে সম্ভার। 'বালবাসর', 'চারম্যান্ডার' কিংবা ' মিউটু'। পড়াশোনা শিকেয় উঠেছে। ছেলেমেয়েরা ইতিহাস-ভূগোল ভুলে অদ্ভুত জীবজন্তুর নাম আওড়াচ্ছে। চিন্তিত অভিভাবকরা। ইস্কুলে বে-আইনি ট্যাজো দেখলে বাজেয়াপ্ত করা চলছে… সবরকমের কড়াকড়ি এড়িয়ে শয়নে-স্বপনে পোকেমন।

তবে এই পাগলামি টিকে ছিল বেশ কিছুদিন। এমন অদ্ভুত কনসেপ্ট তো বাজারে আর আসেনি। ভারতে ২০০৭-০৮ সাল থেকে পড়তে আরম্ভ করে জনপ্রিয়তা। জাপানে যদিও এখনও সর্বজনবিদিত। এই 'ক্রেজ' ফিরে আসে ২০১৬ সালে 'পোকেমন গো'র হাত ধরে। তবে সে অন্য গল্প। বলা যাবে নাহয় আর-একদিন।

আরও পড়ুন
ফিরছে শক্তিমান, টিভির পর্দায় আবার নব্বইয়ের ‘সুপারহিরো’

তবে পোকেমনের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি সরব হয়েছেন নিন্দুকরাও। পশু পাখিদের খাঁচায় বন্দি রেখে, একে অপরের সঙ্গে লড়িয়ে দেওয়া তো মানুষেরই কীর্তি। এই খেলা আদিম। তলিয়ে ভেবে দেখলে, কুৎসিত। ২০১৬ সালে PETA, পোকেমনের ট্যাগলাইনকে নকল করে, আলাদা একটি ক্যাচফ্রেজ বানায়, "Gotta Free'em All."

তবে সবকিছু ভুলে, আ্যশ-পিকাচু'র খুনসুটি বাসা বেঁধে থাকে মনে। মানবিক-পাশবিক-হিংস্রতা-খেয়াখেয়ি পেরিয়ে পড়ে থাকে বন্ধুত্ব।

ছোটবেলার সিংহভাগটাই যে ছিল পোকেমনময়। ভুলি কেমন করে?