অব্যক্ত কথাদের সঙ্গী হয়ে জীবনরহস্যের উৎসবে সামিল হতে চান জন ফসে

কাহিনির জন্য তাঁর লেখা পড়তে বসলে ভুল হবে। নিজের লেখা সম্বন্ধে এমনটাই দাবি করেন জন ওলাভ ফসে (Jon Olav Fosse)। ২০২৩-এর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের (Nobel Prize) সম্মানে ভূষিত তিনি। মানুষের কথা বলতে চান, রোজকার ভাষায় কথা বলতে চান। কিন্তু জীবনের প্রতিটি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে শোনা প্রতিধ্বনিগুলিকে শুধু ‘প্লট’ দিয়ে বন্দি করার পক্ষপাতী একেবারেই নন। বরং খতিয়ে দেখতে চান জীবনের রহস্য। উত্তরগুলি সহজ, কিন্তু তার প্রকাশে জড়িয়ে আছে হাজারো জটিলতা। কত অন্ধকারের হাতছানি স্তব্ধ করে দেয় সবচেয়ে দরকারি কথাগুলিকে। গ্রাস করে ভয়, উৎকণ্ঠা। তিনি সেই রহস্যের উদযাপন চান সাহিত্যে। আর তাই নোবেল কমিটির বয়ান অনুযায়ী না-বলা কথাকে কণ্ঠ দিতে পারেন তিনি।

বিগত একদশক ধরে তাঁর নাম প্রায়ই উঠেছে সম্ভাব্য নোবেলপ্রাপকদের তালিকায়। এবারও বুকিদের ‘ফেভারিট’ ছিলেন। ফসে জানতেন সে ব্যাপারে। মানসিকভাবে প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন তার জন্য। কিন্তু যে মানুষটি সারাজীবন আলো থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন, আজ হঠাৎ করে নোবেল পুরস্কারের আলো একটু ভীত করে দিয়েছে তাঁকে। উপন্যাস আর নাটক লেখার সময় জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বসেন নিজের মুখোমুখি। খানিকটা একাকিত্ব দাবি করেন নিজের জন্য। তাঁর প্রতিটি সাহিত্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে আত্মকথনের ভঙ্গি। তা সে ‘সেপ্টোলজি’-র মতো বিরাট আকারের আত্মজীবনীই হোক, কিংবা ইউরোপের বুকে দাপিয়ে বেড়ানো নাটকগুলি। 

তাঁর জন্ম ১৯৫৯ সালে নরওয়েতে। সাত বছরে একটি দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া তাঁর কাছে ছিল শৈশবের ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা’। সেই ঘটনাই পরে জীবনশিল্পী হয়ে উঠতে সাহায্য করে তাঁকে। একসময়ে শখ ছিল রকসংগীতের গিটারিস্ট হবেন। ২২ বছর বয়সে পুরোপুরি চলে আসেন লেখালেখির জগতে। ১৯৮১-তে বেরোয় প্রথম ছোটোগল্প ’হ্যান’ বা ‘সে’। দুবছর প্রকাশিত পর প্রকাশিত হয় প্রথম উপন্যাস ‘রেড, ব্ল্যাক’। শৈলীকে এখানে তিনি চালনা করেন দুরন্ত আবেগের সাহায্যে। ঘুরে ফিরে আসে আত্মহত্যার চেতনা। বরং দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ক্লোজড গিটার’-এ আত্মস্থ করেন নিজস্ব ভঙ্গি। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত ‘বোটহাউস’ উপন্যাসটি প্রথম তাঁকে আন্তর্জাতিক স্তরে বৃহত্তর পরিচিতি এনে দেয়। তখনও কিন্তু নাটক লেখায় প্রবেশ করেননি তিনি। বরং কিছুটা দ্বিধা ছিল এই নিয়ে। ১৯৯২ সালে লেখেন প্রথম নাটক ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম’। যদিও ১৯৯৪ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয় ‘অ্যান্ড নেভার শ্যাল উই পার্ট’ নাটকটি।

নরওয়েতে নাটককার হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর সময় যেন অত্যন্ত কমে গেল তাঁর কাছে। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে লিখে ফেললেন একের পর নাটক। ১৯৯৭ সালে লিখলেন তিনটি আর ২০০০ সালে লিখলেন চারটি নাটক। এরই মধ্যে ২০০০ সালে তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘ন্যামনেট’ বা ‘দ্য নেম’ মঞ্চস্থ হয় বার্লিন থিয়েটারে। সমগ্র ইউরোপে হেনরিক ইবসেনের ‘উত্তরসূরী’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম। এরই মধ্যে জন ফসে লিখে ফেলেছেন ‘মেলানকলি’-র মতো উপন্যাস। যার দুই খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে। মানসিকভাবে অসহায় এক শিল্পীর ভালোবাসার স্বপ্নগুলি হ্যালুসিনেশনের মতো ভেসে যায় রাতের আকাশে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই একমাত্র আশ্রয় হয়ে ওঠে তাঁর। 

আরও পড়ুন
নোবেলজয়ের দিনেই দেশের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহিতা’র অভিযোগ রাশিয়ার

২০১৩ নাগাদ এক অদ্ভুত পরিবর্তন আসে ফসের জীবনে। সে বছরই দ্বিতীয় স্ত্রী আনাকে বিবাহ করে অস্ট্রিয়াতে বসবাস শুরু করেন। ফসের পরবর্তী জীবনে যাঁর ভূমিকা সর্বাধিক। একই সঙ্গে ত্যাগ করেন মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান। একসময়ে নিজেকে নাস্তিক বলতেন তিনি, এবছরই ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নেন। জীবনে যে স্থিতি আসে, তার নমুনা উঠে আসে লেখাতেও। নোবেল কমিটি যে ‘ফসে মিনিমালিজম’-এর কথা উল্লেখ করেছে, তার সার্থক প্রয়োগ শুরু হয় এই সময় থেকে। স্যামুয়েল বেকেটের মিনিমালিজম-এর ধারণার সঙ্গে নিজের আদর্শ মিশে যায় এখানে। ছোটো ছোটো সাধারণ সংলাপ, দীর্ঘ বিরতি আর পুনরাবৃত্তির মধ্যে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা আত্মার গভীরতাকে। যার নমুনা পাওয়া যাবে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘সেপ্টোলজি’-তেও। মোট সাতপর্বে বিভক্ত উপন্যাসের শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে গতবছর। প্রেম, ঈশ্বর, আশা, দুশ্চিন্তায় নিজের জীবনের কাহিনি বলতে বলতে কখন যেন সবার হয়ে যায় এই কাহিনি। তাঁর নিজের মতে, যদি সাহিত্যের গুণমান যথাযথ হয় তাহলে নরওয়ের এক ব্যক্তির আত্মজীবনী মধ্যেও নিজেকে খুঁজে পাবেন জাপানের কোনো মহিলা কিংবা রাশিয়ার কোনো পঞ্চশোর্দ্ধ মানুষ। সেটাই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।

আরও পড়ুন
বুকারে প্রত্যাখ্যাত উপন্যাসেই নোবেলপ্রাপ্তি; ‘অচেনা’ গুরনাহ্‌ ও উদ্বাস্তুকথন

‘সেপ্টোলজি’-র জন্য প্রভূত সম্মান পেয়েছেন তিনি। ২০টির বেশি ভাষায় অনুদিত হয়েছে উপন্যাসটি। মনোনীত হয়েছিল বুকারের জন্যও। এছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ। অনুবাদ ও শিশুসাহিত্যের জন্যও খ্যাতি রয়েছে তাঁর। নরওয়ের সংখ্যালঘুর নিনোর্স্ক ভাষাকে পৌঁছে দিয়েছেন ইউরোপের সাহিত্যবৃত্তে। যা সে দেশের মাত্র দশ শতাংশ মানুষের ভাষা। একই সঙ্গে মিশে গেছে মাতৃভূমির শিকড়। যে কারণে তিনি মনে করেন এই নোবেল শুধু একার নয়, তাঁর ভাষা এবং নরওয়ের পটভূমিরও। যার সাহায্যে তিনি ফুটিয়ে তোলেন না-বলা বাণীর আখর। নীরবতার শব্দকে ছুঁয়ে যায় জীবনের বিস্ময়। অব্যক্ত ভালোবাসাকে সঙ্গোপনে রাখা মানুষের যন্ত্রণা টের পান তিনি। বহুভাবে সেই জীবনরহস্যের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার স্বীকৃতিই পেলেন এবারের নোবেলের মঞ্চে। 

Powered by Froala Editor