রাস্তার ধারে একটি হোটেল। দুপুর হলেই সেখানে মানুষ এসে ভিড় জমান। কেউ আসেন ব্যস্তসমস্ত হয়ে। কেউ আবার হেলতে দুলতে। অথচ হোটেলে নেই কোনো চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা। নেই ক্যাশ কাউন্টার, ওয়েটার কিছুই। এ আবার কেমন হোটেল? এইসব প্রশ্ন যখন মাথায় ঘোরাফেরা করবে, তখনই ঘন্টি বাজিয়ে হাজির হবে একটি গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে এক স্বেচ্ছাসেবক কাগজ-কলম হাতে এগিয়ে যাবেন ফুটপাতে বসে থাকা মানুষদের দিকে। তারপর সবাইকে জিজ্ঞেস করবেন দুটি প্রশ্ন। “আপনার নাম কী?” এবং “আপনি কি আজ কোনো ভালো কাজ করেছেন?” আর তারপরেই প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হবে খাবারের প্যাকেট।
আজব এই হোটেলের নাম ‘ভালো কাজের হোটেল’। সারাদিনে একটি ভালো কাজ করলেই এখানে বিনামূল্যে খাবার পাওয়া যায়। কী ধরণের ভালো কাজ? ধরুন কেউ এক অন্ধ মানুষকে রাস্তা পারাপারে সাহায্য করেছেন। অথবা কোনো রিক্সাচালক অসুস্থ অসহায় যাত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন বিনামূল্যে। কেউ আবার দুর্ঘটনার হাত থেকে বাঁচিয়েছেন রাস্তার কোনো কুকুরশাবককে। এমনই বিচিত্র নানাকিছু। কোন কাজ ভালো বা কোন কাজ ভালো নয়, তার বিচার করার জন্য নেই কেউ। মানুষ নিজে তাঁর কোনো একটি কাজকে ভালো কাজ মনে করলেই হল। আর যদি কেউ সারাদিনে একটিও ভালো কাজ না করতে পারেন, তাহলেও অবশ্য তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। বিনামূল্যের এই হোটেলেও আছে ধার-বাকির ব্যবস্থা। অর্থাৎ পরেরদিন একসঙ্গে দুটি ভালো কাজ করলেই হবে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ঢাকা শহরের কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কমলাপুর আইসিডি কাস্টমস হাউসের লাগোয়া ফুটপাতে শুরু হয় এই ব্যতিক্রমী হোটেল। যদিও তার অনুপ্রেরণার বীজ নিহিত ছিল বহু বছর আগে। উদ্যোক্তারা প্রত্যেকেই তখন খুব ছোটো। এই সময় হূমায়ুন আহমেদের একটি নাটকে দেখেছিলেন এক ব্যক্তির কথা, যিনি প্রতিদিন একটি করে ভালো কাজ করেন। সেই থেকেই এমন একটা কিছু করার কথা মাথায় এসেছিল সকলের। তারপর বহু বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আবারও ফিরে এসেছেন স্বপ্নের কাছে।
এই উদ্যোগের পিছনে রয়েছে ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’ নামের একটি সামাজিক গোষ্ঠী। কিন্তু কেন এই উদ্যোগ? তারও উত্তর দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাঁদের মতে, একটি ভালো কাজ কেবল একটি ভালো কাজ নয়। সেইসঙ্গে অসংখ্য খারাপ কাজকে পিছনে ফেলে দিতে পারে এই একটি কাজ। বিশেষ করে সমাজের প্রান্তিক জীবিকার মানুষরা অভাবের তাড়নায় অনেক সময়েই খারাপ কাজ করে থাকেন। কেউ চুরি করেন, কেউ মানুষকে ঠকিয়ে বাড়তি রোজগারের চেষ্টা করেন। এগুলো না করলে হয়তো একবেলা না খেয়েই থাকতে হবে তাঁদের। কিন্তু তাঁরাই যদি ভালো কাজ করার বিনিময়ে খাবার পান, তাহলে সমাজে খারাপ কাজের উদাহরণ ক্রমশ কমে আসবে। ২০১৯ সালে সাপ্তাহিক একদিন এই হোটেল বসত। কিন্তু করোনা অতিমারীতে যখন মানুষের খাদ্যাভাব চরমে ওঠে, তখন সপ্তাহে প্রতিদিন হোটেল চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। অবশ্য শুক্রবার এই হোটেল তার নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সরে গিয়ে জায়গা করে নেয় জুম্মার মসজিদের মধ্যে।
আরও পড়ুন
জড়িয়ে দেশভাগের স্মৃতি; ৭০ বছর ধরে বিনামূল্যে খাবার যোগাচ্ছে ‘গরিব হোটেল’
আয়োজন বেশি কিছু নয়, সামান্য খিচুড়ি আরর ডিমের ভুনা। তবে কোনো কোনোদিন পোলাও বা বিরিয়ানিও থাকে। সংগঠনের সদস্যরা এবং আরও বেশ কিছু মানুষ প্রতিদিন ১০ টাকা করে খরচ করেন এই কাজের পিছনে। আর বাজার করা, রান্না করা থেকে খাবারের প্যাকেট পরিবেশন করা – সবই করেন ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা। যাঁদের পথচলার শুরুটা হয়েছিল ২০০৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। এক হতদরিদ্র বাবার অসুস্থ মেয়ের চিকিৎসার জন্য সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অর্থসংগ্রহের কাজে। সবার চেষ্টায় ৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করা গিয়েছিল। আর চিকিৎসার পর সেই মেয়ে সুস্থ হয়েও উঠেছিল। এই একটি কাজই তাঁদের ভালো কাজের ইচ্ছাকে বাড়িয়ে দেয়। পরে এই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনেই ছিন্নমূল শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন বিশেষ স্কুল। পড়াশোনার পাশাপাশি সেখানে শিশুদের জন্যও নিয়মিত খাবারের বন্দোবস্ত রাখা হয়েছিল। ক্রমশ তাঁদের এই ভালো কাজের আগ্রহ ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়ুক আরও বেশি মানুষের মধ্যে। সব সংক্রমণ থেকে তো অতিমারীর জন্ম হয় না।
আরও পড়ুন
ইচ্ছেমতো রেখে আসতে পারেন খাবার, ‘খুশির ঝুড়ি’ নিয়ে দুঃস্থদের পাশে ফরিদপুর
তথ্যসূত্রঃ ভালো কাজের ‘হোটেল’, সজীব মিয়া, প্রথম আলো
আরও পড়ুন
আন্দোলনকারী কৃষকদের খাবারের যোগান দিতে এগিয়ে দিল দিল্লির মসজিদ
Powered by Froala Editor