স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের পিছনে যে সবথেকে বড় অবদান এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দীর্ঘদিনের লড়াই। কিন্তু তার পরেও প্রশ্ন উঠছে, স্বাধীনতা সংগ্রামী কাদের বলব? মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ তো কখনো একরৈখিক ছিল না। প্রত্যেকে নানাভাবে স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীন দেশের। আজকের বাস্তবতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই প্রতিটি স্বপ্ন।
এর মধ্যেই সম্প্রতি সরকারের নানা কথায় উঠে আসছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের নানা বৈচিত্র্যকে মুছে ফেলার। কিছুদিন আগেই আন্দামান সেলুলার জেলের বন্দিদের তালিকা থেকে ৩০০-র বেশি স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম বাদ যায়। আর এই ঘটনার নিস্পত্তি হতে না হতেই আবারও বিতর্কিত সিদ্ধান্তের জন্য আক্রমণের মুখে সরকারের শহিদ স্মারক তালিকায়।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময় থেকে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত দেশের সমস্ত শহিদের নামের তালিকা নিয়ে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘দ্য ডিকশনারি অফ মারটিয়ার্স’। আর এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি সংখ্যা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিশেষ করে কেরালায় রীতিমতো আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন সেখানকার বিধায়করাও।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা বলতে গেলে মালাবার বিদ্রোহের কথা বলতেই হয়। ১৯২১ সালে মালাবার উপকূলে যে মরণপণ লড়াইয়ের শুরু হয়েছিল তার গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। আর সেই আন্দোলনের সময়েই মৃত্যুবরণ করেন বরিয়ামক্ষুন্নত হাজি এবং আলি মুসালিয়ার। কিন্তু শহিদের তালিকায় তাঁদের দুজনেরই নাম নেই। কেন? কারণ বলা হয়েছে তাঁরা নাকি হিন্দু-বিরোধী ছিলেন। এই কথার আদৌ কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় কি? নাকি হিন্দু-বিরোধিতার ভূত সেই ১০০ বছরের পুরনো দুঃস্বপ্ন থেকেও তাড়া করে বেড়াচ্ছে? দুই শহিদের ধর্ম-পরিচয়ই কি এর জন্য দায়ী?
ক্ষুন্নত হাজি এবং আলি মুসালিয়ারের নাম বাদ যাওয়া নিয়ে সরব হয়েছেন কেরালার সর্বস্তরের মানুষ। এই বিষয়ে অবশ্য স্ক্রুটিনির বিষয়টি ভেবে দেখা হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই আরও বেশ কিছু শহিদের নাম নিয়ে স্ক্রুটিনি হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর হিস্টোরিক্যাল রিসার্চ (আইসিএইচআর)। এঁরা প্রত্যেকেই ১৯৪৬ সালে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় প্রাণ হারিয়েছিলেন। আর সেই সরকারের যেহেতু ভারতীয় প্রতিনিধি দল ছিল, তাই তাঁদের শহিদ বলে বিবেচনা করা হবে না। এমনকি এই কারণে তাঁদের দেশদ্রোহী বলেও মনে করছেন কমিটির সদস্য সিআই আইজ্যাক।
আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই দেশের সবচেয়ে বড়ো অংশের মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। স্বাধীনতার নতুন ভোরকে নিজেদের বাসযোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষ। চেয়েছিলেন দেশের নেতারা তাঁদের কথা শুনুক। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের পুলিশ তাঁদের উপরে অবদমন নামিয়ে এনেছে। ভারতের প্রতিনিধি দল থাকলেও মূল ক্ষমতা তো ছিল ব্রিটিশদের হাতেই। নাকি আসলে এইসমস্ত আন্দোলনের পিছনে থাকা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবকেই বাদ দিতে চাওয়া হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে? বামপন্থাকে দেশপ্রেমের বিপরীতে প্রচার করার দীর্ঘ পরিকল্পনার একটি সামান্য প্রচেষ্টাই কি এই তালিকা?
আরও পড়ুন
সেলুলার জেলের ফলক থেকে 'উধাও' তিন শতাধিক বাঙালি বিপ্লবী? শীর্ষে সাভারকরের নাম
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor