নৈঃশব্দের রং সোনালি

‘দাদা, রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লিখুন। আপনাকে খুব ‘মিস’ করছি।’

‘দাদা, পুরোনো ফর্মে ফিরুন, গা গরম হচ্ছে না।’

ফেসবুকে আমার প্রোফাইলে টুকটাক এমন মন্তব্য প্রায়শই দেখতে পাই।

একই কারণে আমার এক অতি-প্রিয় শ্যালক আমার লেখা পড়া বন্ধই করে দিয়েছে। ‘দূর, দূর, এই সব লেখা তোমার ইমেজের সঙ্গে যায় না। হাতে খোলা তরোয়াল নিয়ে তুমি যাকে খুশি কচুকাটা করবে, এটাই তোমার পরিচয়। এর জন্যই লোকে তোমার লেখা পছন্দ করে। এখন যে সব লিখছ তা তোমার চরিত্র-বিরোধী।”

আরও পড়ুন
‘শালা ম্যায় তো নেতা বন গয়া’ – দ্বিতীয় পর্ব

চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতি নিয়ে ক্রমাগত লিখে গিয়েছি, অসংযত ভাষায় ছাপার অক্ষরে রাজনীতিকদের গালমন্দ করেছি, এভাবে হয়তো সত্যিই আমার একটা ব্র্যান্ড আইডেন্টিটি গোছের কিছু একটা তৈরি হয়ে গিয়েছে। সারাটা জীবন খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে এসে কোনো তারকা যদি বুড়ো বয়সে নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, লোকে হয় প্যাঁক দেবে নয়তো হাসাহাসি করবে, ভক্তজনেরা হতাশ হবে। আমার হয়েছে ঠিক সেই হাল। আমি একথাও জানি আমার নতুন-অবতার প্রসঙ্গে এই সব প্রশ্ন ওঠা অতীব স্বাভাবিক। যে লোকটা ব্যাট হাতে মাঠে নামলে বীরেন্দ্র সেহবাগের মতো ঝোড়ো ইনিংস খেলত সে যদি মারব না পণ করে ক্রিজে আসে, কেমন দেখায়?

ডাকু বন গয়া বাপু।

আরও পড়ুন
'শালা ম্যায় তো নেতা বন গয়া' – প্রথম পর্ব

ইচ্ছে করলে আত্মপক্ষ সমর্থনে আমি প্রবাদ আওড়াতে পারি, দেশ-বিদেশের অসংখ্য বরেণ্য মানুষের বলা কথা থেকে উদ্ধৃতিও দিতে পারি। বলতে পারি, ‘স্পিচ ইজ সিলভার, সায়লেন্স গোল্ডেন’, আমি সেই স্বর্ণাভ মৌনব্রতে নিজেকে সমর্পণ করেছি। নৈঃশব্দ পালনের উপকারিতা নিয়েও কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই, চতুর্দিকের এত শব্দ, এত আওয়াজ, এত কোলাহলের মধ্যে দু’দণ্ডের মৌনতা যেন নাটোরের বনলতা সেন। নৈঃশব্দ মনকে শান্ত করে যার ফলে নশ্বর শরীরটাও নানাভাবে উপকৃত হয়। পিথাগোরাস তো সেই কোন আদ্যিকালেই বলে দিয়েছিলেন, ‘এ ফুল ইজ নোন বাই হিজ স্পিচ, ওয়াইজ ম্যান বাই সায়লেন্স।’

আমার চল্লিশ বছরের কর্মজীবন আসলে ওই ‘ফুল’ থেকে ‘ওয়াইজ ম্যান’-এ রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা। বোকা ছিলাম বলেই আমার এক ধরণের পরিচিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল যা আমি নিজেও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে গিয়েছি ওই গণ্ডমূর্খের মতোই। স্তাবক কিংবা একটি অংশের পাঠকের হাততালি, ফেনিল প্রশংসা, আমাকে ক্রমাগত একই বোকামি করে যেতে উদ্বুদ্ধ করে গিয়েছে, আসলে যে আমি বাঁদরওয়ালার ডুগডুগির তালে শরীর দুলিয়ে যাচ্ছি, সেটাই বুঝতে পারিনি। জীবনের উপান্তে এসে আজ মনে প্রশ্ন ঊঁকি দেয় এটা কি আদৌ কোনও অভিপ্রেত পরিচিতি? হয় যদি তাহলে শীতের সাপের খোলস বদলানোর মতো আমারও কি নিজেকে বদলে ফেলা উচিত নয়? আপাতত এই উপলব্ধিই আমার নতুন ভাবনা-চিন্তার একমাত্র চালিকাশক্তি।

আরও পড়ুন
ভাঙায় গড়া মানুষ

জানি হাতে আর বেশি সময় নেই, আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। একেবারে না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া তো মন্দের ভালো, কী বলেন?

গ্রহন-বর্জনের সার্বভৌম স্বাধীনতা আপনাদের। টেক ইট অর লিভ ইট।

রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত কুশীলবদের যা কলমের ডগায় আসে তাই বলে গাল দিয়েছি। প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বলেছি, ‘কীর্ণাহারের ব্রাহ্মণকূলের ক্ষুদ্র অংশের নেতা’। 

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য—‘বিপ্লবী আধা-কবির বাংলা অনার্স পড়া ভ্রাতুষ্পুত্র’।

প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি— ‘রাজনীতিতে কীভাবে সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় মিথ্যে কথা বলতে হয়, শিক্ষানবীশরা তা প্রিয়র পাঠশালায় শিখতে পারেন।

মমতা বন্দোপাধ্যায়- ‘পটুয়াপাড়ার অগ্নিকন্যা’।

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়—‘মৌ দাদা’।

সোমেন মিত্র— ’কালোয়ার’।

আরও আছে, আমি তার পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা। শুধু এইটুকু অকপটে বলি, পিছনে ফিরে তাকিয়ে এর জন্য এখন আমার ঘোরতর লজ্জা হয়। বুঝতে পারি তখন বয়স কম ছিল, ধমনীতে গরম রক্ত বইত, হিতাহিতজ্ঞান ভুলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যা যথেষ্ট ছিল। আজকের পরিবেশে এই ধরণের কটূ কথা বলার অবকাশই নেই, কেন নেই তার ব্যাখ্যাও নিষ্প্রয়োজন। আজকের পরিবেশের সার কথা হল, হয়  নাম-সংকীর্তনে নেমে যাও নতুবা দেশোদ্ধারের স্বপ্ন কুলুঙ্গিতে উঠিয়ে রেখে মৌনীবাবা হয়ে থাকো। আমি সচেতনভাবে দ্বিতীয় পথটি বেছে নিয়েছি। অনভ্যস্ত হৃদয়ে একেবারে রক্তক্ষরণ হয় না তা নয়, ধরে নিয়েছি দিশা পরিবর্তনেরও মূল্য চোকাতে হয়।

যৎপরোনাস্তি সংক্ষেপে বললে, আগে রাজনীতিকদের গালাগাল দিয়ে দিব্যি পার পাওয়া যেত, এখন যায় না। একটু আগে যাঁদের নাম বললাম তাঁদের কারও সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক লেখার কারণে নষ্ট হয়নি। সম্পর্কে একটা ধাক্কা লেগেছে ঠিকই, তার মেয়াদ ছিল নেহাতই সাময়িক। প্রণব মুখোপাধ্যায় তো বুঝতেই দিতেন না, ভিতরে ভিতরে তিনি কতটা ক্ষিপ্ত হয়ে বসে আছেন। প্রিয়বাবুর ফেভারিট প্রতিক্রিয়া ছিল টানা কয়েক সপ্তাহ বাক্যালাপই বন্ধ করে দেওয়া। আর মমতা? তিনি ছিলেন তাঁর মতোই, ব্লো হট, ব্লো কোল্ড। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে আমার নাম শুনলেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন, রাজ্য প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়ার পরে তাঁর-আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের রসায়ন একেবারে বদলে যায়। অকপটে কথা বলতে অভ্যস্ত বুদ্ধবাবু একবার আড্ডার মধ্যে বলেই ফেলেছিলেন, “আপনার সমালোচনা পড়ে আগে শরীর রাগে চিড়বিড় করত। এখন মনে হয় সে সময় সেটা আমাদের বোধহয় প্রাপ্যই ছিল।” 

এত সব দৃষ্টান্ত দেওয়ার একটাই কারণ, এই সেদিন পর্যন্ত ভারতীয় গণতন্ত্রে মিডিয়ার সঙ্গে শাসকের সম্পর্ক ছিল প্রতিপক্ষের, দু’তরফই একে-অন্যকে ‘নেসেসারি ইভল’ ধরে নিয়ে পরস্পরকে সহ্য করত। এই নিত্যদিনের লড়াইয়ে কোনো পক্ষই কখনও বিজয়ী হত না, এটা জয়-পরাজয়ের ব্যাপারই ছিল না। আমূল বদলে গিয়ে এখন ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এই রকম - আয়দার ইউ আর উইথ আস অর এগেইনস্ট আস। সঙ্গে যদি থাকো রসে-বশে রাখব, না থাকলে...

বৈকুণ্ঠের ডাক শুনতে পাচ্ছি আমি, ভাড়া করা সময়ের মেয়াদ নিয়ে আমি নিজেই নিশ্চিত নই। তরোয়াল চালাব কী, তোলার ক্ষমতাটাই যে আমার আর অবশিষ্ট নেই। জীবনে কারণে-অকারণে কিছু হাততালিও জুটেছে, এখন আর তা আকৃষ্ট করে না। রবিঠাকুরের আকুতি এখন আমারও অভীষ্ট।

‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে!’

উপসংহারে পৌঁছনোর আগে একটা খুবই জরুরি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে রাখি। আমি ক্রোধ বা অভিমানের বশে কথা বলছি না, সেটা যে চরম নির্বুদ্ধিতা এইটুকু বোঝার মতো স্বল্পবুদ্ধি আমারও আছে। কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে চাঁদমারি ঠাওরানোর অভিপ্রায়ও আমার নেই। লাঞ্ছনার অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমি হাড়েহাড়ে বুঝেছি, শাসকের ঝান্ডার রং যত বহুবর্ণই হোক না কেন শাসনের চরিত্র একই সুরে গাঁথা, শ্রীনগর থেকে রামেশ্বরম, সর্বত্র। অসহিষ্ণুতা, প্রতিহিংসা, অবাধ্যকে সবক শেখানো আজকের যুগ-ধর্ম, পার্থক্য যদিবা থাকে সেটা উনিশ-বিশের। শাসনের এমন নাটকীয় রূপান্তর কীভাবে হল সেই বিতর্ক স্বতন্ত্র। মা যা ছিলেন তিনি আর তা নেই, যে ভয়াল রূপ তিনি ধারণ করেছেন তার সামনে দাঁড়ালে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যায়, গভীর বিপন্নতাবোধ গোটা অস্তিত্বকে গ্রাস করে, নিরাপত্তার খোঁজ মেলে নিভৃত কোণে, সঙ্গোপনে, একমাত্র নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপে। 

আমি বক্তা, আমিই শ্রোতা, আমি লেখক, আমিই পাঠক। এমন একটা সুখী বন্দোবস্তে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। বাকি দিনগুলিও এভাবে কাটাতে পারলে নিজেকে অশেষ ভাগ্যবানই মনে করব।

Powered by Froala Editor

Latest News See More