সামুদ্রিক প্রাণীদেরও ঘাতক হয়ে উঠছে শব্দদূষণ, চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এল গবেষণায়

অ্যালজাইমার, হাইপারটেনশন, মানসিক চাপ, মাইগ্রেন, স্নায়বিক সমস্যা, এমনকি হৃদরোগের মতো অসুস্থতার কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন শব্দদূষণকে। তবে শুধুই কি মানুষের ওপরেই প্রভাব ফেলছে এই ঘাতক দূষণ? সম্প্রতি চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এল গবেষণায়। এককথায়, শব্দদূষণ থেকে মুক্তি নেই কোথাও-ই। সুমেরু থেকে শুরু করে শান্ত বেরেন্টস সাগরের গভীরেও পৌঁছে গেছে শব্দদূষণের রেশ। আর যা ভয়ঙ্কররকম প্রভাব ফেলছে সমুদ্রের প্রাণীদের ওপর।

বিগতও কয়েক বছর ধরে, শব্দ প্রযুক্তিবিদ জনা উইন্ডারেন বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে রেকর্ড করেন মনুষ্যসৃষ্ট শব্দের ক্লিপিং। মূলত সমুদ্রতলের গভীরের জগতেই এই পর্যবেক্ষণ চালান জনা। আর তাঁর সংগ্রহ করে আনা তথ্যের ভিত্তিতেই সাম্প্রতিক এই গবেষণা চালিয়েছেন বিশ্বের প্রথমসারির প্রায় ১০ হাজারের বেশি বিজ্ঞানী এবং ২৫টি আন্তর্জাতিক সংস্থা।

এই গবেষণা থেকেই উঠে আসে - মোটরবোট হোক কিংবা পাইল ড্রাইভিং, উইন্ডমিল, কার্গো শিপ, ইঞ্জিন, পাম্প, এমনকি স্কুবা ড্রাইভিংয়ের শব্দও ঘাতক হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের কাছে। এই শব্দ মানুষের শ্রবণযোগ্য না হলেও, সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে তার মাত্রা অত্যন্ত বেশি। এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের ক্ষেত্রে প্লাস্টিক দূষণের থেকেও ভয়ঙ্কর তার প্রভাব।

কিন্তু কীভাবে প্রভাব ফেলছে শব্দদূষণ? গবেষকরা জানাচ্ছেন বিভিন্ন মাছ, সিল, ডলফিন, তিমির মতো প্রাণীরা চলাচল করে শব্দের ওপর নির্ভর করেই। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমও শব্দই। তবে সেই শব্দের কম্পাঙ্ক অত্যন্ত কম। দ্রুত কম্পাঙ্কের শব্দ স্থায়ীভাবে ক্ষতি করছে এই ধরণের প্রাণীর শ্রবণেন্দ্রিয়ের। আর ধীরে ধীরে শ্রবণশক্তি হারানোর ফলে অনেক সময় দুর্ঘটনার শিকারও হচ্ছে এইসব প্রাণীরা। তিমি ও ডলফিনের গণমৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে শব্দদূষণকেই চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। নেভিগেশনের ক্ষমতা হারানোর ফলে অগভীর সমুদ্রতটে এসে আটকে পড়ছে তারা।

তবে এখানেই শেষ নয়। বেশ কিছু সামুদ্রিক প্রজাতির ধীরে ধীরে শারীরিক অবনতিও চোখে পড়েছে বিজ্ঞানীদের। সেই দুর্বলতা ও চর্মসার হয়ে ওঠার কারণও শব্দদূষণই। শ্রবণক্ষমতা হারানোর ফলে খাদ্য সনাক্তকরণেও সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। অনাহারে কাটাতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়। সেই সঙ্গে কমছে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাও। 

এক কথায় শব্দদূষণের প্রভাব যে কতটা সুদূরপ্রসারী সমুদ্রের অতলে, তার বিবরণ দেওয়াও দুঃসাধ্য। অন্যদিকে মনুষ্যসৃষ্ট শব্দের কম্পনে দ্রুত গলন হচ্ছে মেরু বরফের। সেখানেও সামুদ্রিক প্রাণীদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেরু অঞ্চলের স্থলচর প্রাণীরাও।

আরও পড়ুন
তিমির পূর্বপুরুষ? জুরাসিক যুগের সামুদ্রিক প্রাণীর হদিশ দিল জীবাশ্ম

তবে এর মধ্যেও সামান্য আশার আলো দেখাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। কার্বন বা প্লাস্টিকের মতো এই দূষণ চিরস্থায়ী নয় প্রকৃতিতে। শব্দদূষণ সম্পূর্ণভাবে সমাধান করা যেতে পারে শুধুমাত্র শব্দের উৎসগুলিকে বন্ধ করেই। তার জন্যই একাধিক প্রযুক্তির সন্ধান দিয়েছেন এক্সটার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও সহ-লেখক লুসিল চ্যাপিস। শব্দদূষণের উৎসগুলিকে বন্ধ না করতে করেও, শব্দ পরিশোধনের বেশ কয়েকটি উপায় জানিয়েছেন তিনি। তার জন্য প্রতিটি দেশের প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে পরিবর্তনের লক্ষ্য। না হলে সামগ্রিকভাবে বদলাবে না এই ছবি। ‘সায়েন্স’ বিজ্ঞান পত্রিকায় এই গবেষণাপত্র প্রকাশ পাওয়ার একমাসের মধ্যেই রীতিমতো শোরগোল পড়ে যায় বিভিন্ন মাধ্যমে। এখন দেখার প্রশাসন কতটা কর্ণপাত করে গবেষকদের এই আবেদনে…

Powered by Froala Editor