মহামারী করোনার দোসর হয়ে এসেছে দারিদ্র্য আর অনাহার। বন্ধ রোজগারের সমস্ত পথ। দুবেলা দু-মুঠো খাবার জোগাড় করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এরকম সময়ে পৃথিবীতে শান্তির আরেক নাম খাদ্য। এবছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার তাই কোনো ব্যক্তির উদ্দেশে নয়, বরং দেওয়া হল ক্ষুধা দূরীকরণের সম্মিলিত দলবদ্ধ প্রয়াসকেই। আজ তাই নোবেল ফাউন্ডেশনের ঘোষণায় একটু অবাক লাগলেও মনে হয় এটাই তো হওয়ার ছিল।
বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে পৃথিবীর প্রায় ৩০০ মিলিয়ন মানুষ অনাহারের মুখে এসে পড়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন পরিস্থিতি আর কখনো দেখা যায়নি। তবে এই পরিস্থিতিতেও পিছিয়ে আসতে রাজি নয় ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। বরং তার ৬ দশকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় খাদ্য সহায়তা প্রকল্প তৈরি করল ডব্লিউএফপি। শুরু হল অর্থসংগ্রহের কাজ। আর এর ফলে ১৩৮ মিলিয়ন মানুষের জন্য শুরু হল প্রকল্পের কাজ।
১৯৬০ সালে জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছিল ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন। আর ১৯৬৬ সালে ফাওয়ের উপদেশেই তৈরি হল আরও একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। তার নাম দেওয়া হল ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। প্রথমে সারা বিশ্বের ৭৫টি দেশে কাজ শুরু করে ডব্লিউএফপি। পরে সেই কাজের পরিসর বেড়ে ৮৩টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে সংস্থার কাজ। আর করোনা পরিস্থিতিতে আরও ৫টি দেশে কাজ শুরু করে ডব্লিউএফপি। প্রতি বছর গড়ে ১০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে এই সংস্থা।
শুধুই মানুষের খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা নয়, বরং নানা ধরনের অভিনব প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ডব্লিউএফপি। অনাহারের পাশাপাশি যুদ্ধ, উদ্বাস্তু সমস্যা এবং নানা ধরনের সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার ব্যাপারে মিলিত উদ্যোগ চালিয়ে যায় ডব্লিউএফপি। খাদ্যহীন মানুষের খাদ্য সংগ্রহ করার পাশাপাশি খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সংস্থার কাজ বেশ অভিনব। বড় ধরনের ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে সরাসরি ছোট কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে ডব্লিউএফপি। গড়ে প্রতি বছর ৩.৬ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয় সরাসরি কৃষকদের থেকে। এর ফলে তাঁদের রোজগারের রাস্তাও অনেকটাই সুরক্ষিত থাকে। কৃষকদের পুষ্টিকর শস্য উৎপাদনের পাশাপাশি নানা অর্থকরী শস্যের উৎপাদনেও উৎসাহ দেয় সংস্থা।
২০০৪ সালে একটি অভিনব প্রকল্প নিয়ে এসেছিল ডব্লিউএফপি। অবার্ন ইউনিভার্সিটির পড়ুয়াদের নিয়ে তৈরি হয় একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। আর প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়, ‘ওয়ার এগেইনস্ট হাঙ্গার’ অর্থাৎ ক্ষুধার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধের সেনানী পড়ুয়ারাই। এরপরেই নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি সহ আরও নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের জড়িয়ে নেওয়া হয় এই প্রকল্পে। ২০১৮ সালে বেনসন টেলরের নেতৃত্বে তৈরি হয় উদ্বাস্তুদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ কমিটি। এর মধ্যে সিরিয়া এবং নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যেও মানুষের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এই সংস্থা।
যদিও জাতিপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে থাকা নানা সংস্থার মতো ডব্লিউএফপি-ও বিতর্কমুক্ত নয়। তবে মানুষের খাদ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যে এই মুহুর্তে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ, সেবিষয়ে সন্দেহ নেই। নোবেল ফাউন্ডেশনের স্বীকৃতি আবারও সেই কথাই প্রমাণ করল। হয়তো এবছরের ওয়াক দ্য ওয়ার্ল্ড অনুষ্ঠানে মানুষের অংশগ্রহণ আরও খানিকটা বাড়বে। আরও বেশি সংখ্যক মানুষের নেতৃত্বে সংস্থার কাজ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। আর মানুষের মিলিত উদ্যোগে গড়ে উঠবে একটা সুন্দর পৃথিবীর ছবি।
তথ্যসূত্রঃ ইউএনডব্লিউএফপি
Powered by Froala Editor