পরমাণুও যে আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণার সমন্বয়ে তৈরি, ইলেকট্রন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তা প্রথম সামনে এনেছিলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। তারপর একে একে আবিষ্কৃত হয়েছিল প্রোটন, নিউট্রন। তবে বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় একাধিক গবেষণা ও তত্ত্ব জানান দেয়, এই কণাগুলিও তৈরি হয়েছে আরও সূক্ষ্ম বিভিন্ন কণার সমন্বয়ে। তবে সবটাই তখনও পর্যন্ত তত্ত্ব। কিন্তু তাদের বাস্তব অস্তিত্ব চিহ্নিত করার পদ্ধতি তখনও পর্যন্ত অধরাই মানুষের কাছে। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম এই পথেরই সন্ধান দিয়েছিলেন একদল মার্কিন পদার্থবিদ। জানিয়েছিলেন, প্রোটন, নিউট্রনের মতো ভারি হ্যাড্রন কণার সংঘর্ষের মাধ্যমেই প্রকাশ্যে আনা সম্ভব হতে পারে অন্যান্য সূক্ষ্ম কণাগুলির অস্তিত্ব। সেই মতো আশির দশকের শেষে শুরু হয়েছিল ভূগর্ভে ২২ মাইল দীর্ঘ টানেল তৈরির কাজ। তড়িৎচুম্বকীয় বলের সাহায্যে যেখানে দুটি কণাকে ত্বরান্বিত করে সংঘর্ষ ঘটানো হবে তাদের মধ্যে।
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই মডেলের সঙ্গে সকলেই পরিচিত আমরা। সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের ছবিই ভেসে উঠছে নিশ্চয়ই মনে? ২০০৮ সালে স্থাপিত হওয়ার পর থেকে হিগস বোসন-সহ শতাধিক মৌলিক কণার হদিশ দিয়েছে এই কোলাইডার। না, শুরুতে উল্লেখিত কণাত্বরকটি এলএইচসি নয়। আশির দশকে শুরু হওয়ার সেই মার্কিন প্রোজেক্ট, সুপারকন্ডাকটিং সুপার কোলাইডার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক টানাপোড়েনে। পরবর্তীতে সেই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে এলএইচসি। আর যুগান্তকারী সেই চিন্তাভাবনার অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন নোবেলজয়ী মার্কিন পদার্থবিদ স্টিভেন উইনবার্গ।
গত ২৩ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে প্রয়াত হন কিংবদন্তি পদার্থবিদ। বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘ কয়েক মাস অসুস্থ থাকার পর টেক্সাস প্রদেশের অস্টিনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রয়াত হন উইনবার্গ। আধুনিক পদার্থবিদ্যা বিশেষত কণাতত্ত্বের আধুনিক মডেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
১৯৩৩ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে জন্ম উইনবার্গের। বাবা-মা ছিলেন ইহুদি শরণার্থী। নিউ ইয়র্কের প্রান্তিক একটি আদালতে কোনোক্রমে স্টেনোগ্রাফারের কাজ জুটিয়েছিলেন তাঁর বাবা। নতুন শহরে এসে জুত করা ওঠা এক কথায় দুষ্কর। তার ওপর সেটা যদি গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় হয়, তবে তো কথাই নেই। অনটন ছিল পরিবারের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে তাঁর পড়াশোনায় এই আর্থিক অভাবের প্রভাব পড়তে দেননি তাঁর বাবা-মা। ওয়াইনবার্গকে ভর্তি করেছিলেন নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কস সায়েন্স হাই স্কুলে। বিজ্ঞান থেকে পাথেয় করে এগিয়ে যাওয়ার যাত্রাপথের সূচনা সেই থেকেই। তারপর সেখান থেকে কর্নেল ইউনিভার্সিটি, কোপেনহেগেনের নিলস বোর ইনস্টিটিউট। পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করার পর প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক স্যাম ট্রিম্যানের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন গবেষণা। ১৯৫৭ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে পিএইচডি করার পর উইনবার্গ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন ওয়াইনবার্গ। সেইসঙ্গে চলতে থাকে মৌলিক কণার ওপর গবেষণাও।
আরও পড়ুন
স্টিফেন হকিং-এর কাছে তিনি ‘গ্রেটেস্ট’, বিস্মৃতির অতলে বাঙালি পদার্থবিদ জে এন ইসলাম
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় সেটা। ততদিনে প্রকৃতিতে উপস্থিত বলগুলিকে মূলত চারটি বিভাগে ভাগ করে ফেলেছেন পদার্থবিদরা। উইনবার্গ কাজ শুরু করলেন স্ট্রং ফোর্স এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল নিয়ে। তৈরি করে ফেললেন একটি বিশেষ মডেল। যা মূলত কিছু কাল্পনিক এবং তাত্ত্বিক কণার সেট। উইনবার্গ জানালেন, এই কণাদের মধ্যে বিভিন্ন ইন্টার্যাকশনই জন্ম দেয় বলগুলির। তবে শুধু উইনবার্গ নন, এই একই কাজ ভিন্ন পদ্ধতিতে করেছিলেন আরও দুই মার্কিন গবেষক— আবদাস সালাম এবং শেলডন গ্ল্যাসো। উল্লেখ্য, সালাম এবং শেলডন দু’জনেই ছিলেন ব্রঙ্কস সায়েন্স হাই স্কুলে উইনবার্গের সহপাঠী।
আরও পড়ুন
কলকাতার বুকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের কোর্স, পারিশ্রমিক ১০টি সোনার মোহর!
আশির দশকের শুরু থেকেই তিন পদার্থবিদের তাত্ত্বিক মডেল অনুযায়ীই আবিষ্কৃত হতে থাকে একের পর এক মৌলিক কণা। অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় জটিলধর্মী কোয়ার্কের। যুগান্তকারী এই আবিষ্কারের জন্যই তিন সহপাঠী যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৯ সালে। যদিও উইনবার্গ নিজেকে ‘মডেলমেকার’ হিসাবে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হয়েছেন চিরকাল। নিজের লেখাতেই একাধিকবার উল্লেখ করেছেন, তিনি গোটা জীবনে কেবলমাত্র একটি তাত্ত্বিক কণার মডেলের জন্ম দিতে পেরেছেন।
আরও পড়ুন
গবেষণার সঙ্গে নারীশিক্ষার প্রসারে লড়াই, ফ্রান্সের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি পেলেন ভারতীয় পদার্থবিদ
তবে শুধু বিজ্ঞানের কথা উল্লেখ করলে, ফাঁক থেকে যায় তাঁর সম্পূর্ণ জীবনদর্শনে। কারণ, শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যার গবেষণাপত্র প্রকাশ নয়, একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সারির বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞানের ইতিহাস, রাজনীতি, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম নিয়েও ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন উইনবার্গ। নাস্তিক উইনবার্গের কথায়, ধর্মই মানবসভ্যতার মূল বেড়াজাল। অন্ধবিশ্বাস থেকে শুরু করে যুদ্ধ, দাসত্ব সবকিছুই জন্ম দিয়েছে ধর্ম। হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবসভ্যতার মূল প্রতিবন্ধকতা। দৃপ্ত কণ্ঠেই এমনটা জানিয়েছিলেন উইনবার্গ। এই মন্তব্যের জন্য অবশ্য পিছু ছাড়েনি বিতর্কও। তাছাড়াও যুক্তরাজ্যে ইসরায়েলিদের নিষিদ্ধকরণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েতের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ, বিজ্ঞানের প্রতি সরকারের অবহেলা— প্রতিটি বিষয়েই যুক্তি দিয়েই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কিংবদন্তি নোবেলজয়ী। সব মিলিয়ে দেখতে গেলে, বিজ্ঞানীর পরিধি ছাড়িয়ে উইনবার্গ ছিলেন একজন আদর্শ প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব। বিজ্ঞানের জগতে তাঁর কৃতিত্বকে হয়তো আগামীতে ছাপিয়ে যাবেন অনেকেই। কিন্তু তাঁর মতো প্রগতিশীল চিন্তাধারার দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তিকে কি আদৌ পাবে বিশ্ব? সেই জায়গাতেই থেকে যায় প্রশ্নচিহ্ন…
Powered by Froala Editor