সভা-সমিতিতে নয়, বিরলে বসে নিঃশব্দে পড়ার কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন নিশীথ ভড়

একটা ছেঁড়াখোঁড়া ডায়েরির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, আজ প্রায় আট-ন মাস হতে চলল! সেই ডায়েরির বয়স চল্লিশ বছর। প্রথম কয়েকটা পাতা দেখলে হয়তো যে কেউ ভুল করে ভেবে বসবে, এ নির্ঘাত কোনো বাচ্চার বেড়ে ওঠার দিনলিপি। শুধু রঙের দাগ, কাটাকুটি আর নতুন নতুন শব্দ শেখার খসড়া। পরেও অবশ্য সে-নমুনা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে, সঙ্গে গাদা গাদা হিসাব-নিকেশ। কিন্তু এর তলায় এতদিন ধরে যা চাপা পড়ে ছিল, তা একজন কবির জীবন। কেমন ছিলেন সেই কবি? কৃশকায়, মায়াবী, মুখচোরা-লাজুক, বন্ধুবৎসল আর আপাদমস্তক বিষণ্ণতায় মোড়া। এই কবি সারাজীবন ধরে নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলে গেছেন, নিবিড়ভাবে ভেবেছেন জীবন নিয়ে, তাঁর কবিতা নিয়ে। ভিড়ের মধ্যেও তিনি ছিলেন একলা, নিঃসঙ্গ। ১৯৭৮-’৮২ কালপর্বের অপ্রকাশিত সেই ডায়েরি থেকে আমি দু-তিনটি অংশ এখানে কেবল নমুনা হিসাবে উদ্ধৃত করছি, শুধু তাঁর মনের একটা আভাস দেওয়ার জন্য :

১. ‘...আত্মজিজ্ঞাসার অধিকার থেকে যেমন যেকোনো বিদ্যা ও ধর্মের আবির্ভাব, কবিতারও জন্মসূত্র তাই। আত্মজিজ্ঞাসাই আমাদের ভবিষ্যত কর্মপ্রবর্তনার দিকে নিয়ে যায়।… কল্পনা আর বাস্তব, বই আর বর্তমান, প্রত্যক্ষ আর অপ্রত্যক্ষ এ-সমস্তই আমাদের জানা-অজানার মধ্যে, নিরন্তর ফারাক আর মিলনের মধ্যে কবিকে গড়তে থাকে ক্রমশ। তাই আর সব মানুষের মতো কবিরও জানা নেই সে কী হয়ে উঠবে।…’

২. ‘... কাল একটা কবিসম্মেলন হল। হাততালি পেলাম প্রচুর। লক্ষ করে দেখেছি আমার যে সমস্ত superficial reality নিয়ে লেখা, সেগুলোই ভালো লাগে লোকের। অথচ আমি ওরম লেখা লিখতে চাই না। চাই গভীর, মর্মজ্ঞ, মায়াবী কিছু লিখতে, যা সভায় পড়া যায় না, বিরলে বসে, নিঃশব্দে পড়তে হয়।…’

৩. ‘... দুঃখ, আমার আনন্দকে, আমি দু-হাতে নিবিড়ভাবে পাব। সব মানুষের আত্মা নেই। অথচ আত্মা দিয়ে আত্মাকে দেখাই ঠিক দেখা। সেই আত্মাই লাভ করতে হবে আমাকে। আমার জীবন সত্যে প্রবেশ করুক, সত্যময় হয়ে উঠুক, এই একটামাত্র প্রার্থনাই ধ্বনিত হোক আমার নিঃশব্দে।…’ 

এই কবি, অর্থাৎ নিশীথ ভড়কে আমি কখনো স্বচক্ষে দেখিনি। দেখার কথাও নয় অবশ্য। ১৯৫০ সালের ১০ নভেম্বর তাঁর জন্ম, আর ২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি যেদিন তিনি প্রয়াত হন তখন আমি মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোইনি! তবু ভাবতে ভালো লাগে, শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের একটা বড়ো সময় তিনি কাটিয়েছেন আমার বাড়ির ঠিক অদূরেই। ঠিকানা : ২এ মাধব দাস লেন। ১৯৭০ সালে এখান থেকেই প্রকাশিত হয় কবি অমিতাভ গুপ্তর কবিতাবই ‘আলো’ এবং কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের ‘দেবী’। প্রকাশনা : অভিজ্ঞান, প্রকাশক : নিশীথ ভড়। 

মনে রাখতে হবে, তখনও পর্যন্ত তাঁর নিজের কিন্তু কোনো বই নেই। এমনকি কোনো পরিকল্পনাও ছিল বলে আমার মনে হয় না। কেননা তিনি তাঁর লেখার ব্যাপারে ছিলেন ভয়ংকর রকমের খুঁতখুঁতে। ফলে ১৭/১৮ বছর বয়স থেকে লেখা শুরু করলেও তাঁর প্রথম বই বের হয় সেই ৩৪ বছর বয়সে গিয়ে, ১৯৮৪ সালে। সে-বইও পরম যত্নেই তৈরি করা। কোন কোন লেখা যাবে, কোন লেখার পর কোন লেখা যাবে সেসব নিয়ে যে একাধিকবার চিন্তা করেছেন তিনি, তার চিহ্ন ওই ডায়েরিতে ধরা আছে। কিন্তু ৩৯টি কবিতা নিয়ে সেই বইয়ের (‘নিজের পায়ের শব্দ’) পর, আর মাত্র দুটোই রোগা কবিতার বই বের হয়। ‘খেলার তুচ্ছে প্রতিমা’(১৯৮৬) এবং ‘তীর্থসংহার’(১৯৮৭)। 

আরও পড়ুন
ট্রেনের কামরায় আঁকা সহজপাঠের ছবি ও কবিতা, চমক শিয়ালদা রেল কর্তৃপক্ষের

ওই সময় থেকেই কোথাও যেন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছিলেন তিনি কবিতা লেখা থেকে। নইলে যিনি তাঁর লেখালিখি নিয়ে এত গভীরভাবে ভাবতেন, পর পর দু-বছর দুটো বই করে ফেলার মতন হঠকারী সিদ্ধান্ত কি তাঁকে মানায়? নব্বই পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখা আর সেভাবে পাওয়া যায় না। এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন, লেখালিখির জগৎ থেকে অনেকটা দূরে দূরেই। এখানে একটা তথ্য শুধু দিয়ে রাখি, বন্ধু অন্ত প্রাণ এই কবির তিনটি বইয়ের প্রকাশকই ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ দুজন বন্ধু। দুটির প্রকাশক সোমক দাস ও একটির পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল।

রাবণ প্রকাশনা থেকে সোমাইয়া আখতার ২০১৩ সালে নিশীথ ভড়ের যে ‘কবিতা সংগ্রহ’ প্রকাশ করেন, তার মধ্যে দিয়ে আমাদের মতন এ-প্রজন্মের পাঠকদের কাছে আরও একবার সুযোগ ঘটে বিস্মৃতপ্রায় এই কবিকে আবিষ্কার করার। শুরুতে পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের একটি অসামান্য স্মৃতিকথনে ধরা পড়ে তাঁর জীবনের আরও কিছু তথ্য। যেমন :

১. ‘... স্কুলের পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, আ ভারস্যাটাইল জিনিয়াস।…’
২. ‘...উচ্চমাধ্যমিক দেবার আগেই নিশীথ একটি ছোটোকাগজ সম্পাদনা করলেন, নাম ‘সময়’।… ‘সময়’ ক্ষীণাঙ্গ হলেও শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা সাগ্রহে লিখতেন।…’
৩. ‘... ৭৬-এর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিধ্বস্ত বিপন্ন অমিতাভ বসু আমার বাড়ি দৌড়ে এলেন। নিশীথ চিত্তব্যাধিতে অসুস্থ। তার তীব্রতা খুবই বেশি।… এবং ব্যাধিবিকল নিশীথ সেই অবস্থায় নিজের অসম্পূর্ণ দুটি উপন্যাস, আটটি ছোটোগল্প এবং দুশো সত্তরের বেশি কবিতার পাণ্ডুলিপি আগুনে দিলেন!...’

আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কবিতা লিখলেন গুলজার, ছড়িয়ে পড়ল নেট দুনিয়ায়

বোঝাই যাচ্ছে, আমরা এ-পর্যন্ত কবির যতটুকু পাই তা কতটা অসম্পূর্ণ! পুরোনো দিনের লিটিল ম্যাগাজিনের পাতায়-পাতায় এখনও লুকিয়ে আছে, তাঁর অজস্র কবিতা। এমনকি যে-সময়ে তাঁর অসুস্থতা প্রবল, কবিতা লেখার মতন স্নায়বিক চাপ সহ্য করবার ক্ষমতা ছিল না-- তখনও সবার আড়ালে নিজের মতন করে লিখে গেছেন অনেকদিন। কিছু প্রকাশ করেছেন, কিছু করেননি। বইয়ে সেখান থেকে নির্বাচন করেছেন আরও কম। ফলে তাঁর গ্রন্থিত লেখার তুলনায়, শুধু প্রাপ্ত অগ্রন্থিত লেখাই প্রায় আড়াই গুণ। তাঁর ছন্দদক্ষতায় সে-সময়ে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। রণজিৎ দাশ যে মন্তব্য করেছিলেন, তাঁর কবিতা সম্পর্কে (‘প্রাণবন্ত লিরিক ও যন্ত্রণার্ত আধুনিক’) তা খুবই যথাযথ মনে হয় আমার। 

উপরের সামান্য কয়েকটা কথা আসলে নিশীথ ভড় সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরির গলি। যেখানে ঢুকলে দেখা যাবে, জীবন ও কবিতার বিরাট দুর্গে বন্দি একজন মানুষের ছটফট করতে থাকার দৃশ্য। শোনা যাবে আর্ত চিৎকার। জীবনকে যে বারংবার শুধু উলটে-পালটে দেখতে চেয়েছিলেন। পৌঁছোতে চেয়েছিলেন তার মর্মমূলে। আর ক্লান্তি, অবসাদে ঘেরা একটা জীবনে পুড়তে পুড়তে আত্মমগ্নতার আলোয় ছুঁতে চেয়েছিলেন কবিতার সত্যকে। বিস্তারিত আলোচনার পরিসর এটা নয়। কেউ কেউ আগ্রহী হতে পারেন ভেবে দুটো পছন্দের কবিতা দিয়ে, এই লেখার ইতি টানছি...

‘ভালোবাসা যেতে পারে শান্ত দু মাইল শাদা পথ
পথ শব্দটির কোনো বিকল্প ছিল না তাই বিপত্তি ঘটেছে
আজো সংসারের মধ্যে: সারাপথ খুব চুপচাপ
কে যে শুয়েছিল, তাকে ভালোবাসা উপেক্ষা করেছে।’
(পথ)

আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে রবীন্দ্রনাথকে ডাকলেন প্রবোধকুমার, আবৃত্তি করে শোনালেন কবিতাও!

‘তোমার শরীরের আলো এসে পড়ুক আমার চোখের ওপর
                                  আমার অন্তরাত্মায়
আর অল্পে-অল্পে জেগে উঠুক ছোটোবেলার সকাল
সূর্য ওঠার আগে শুকতারার শুচিতার কাছে ঋণ
ওগো মেয়ে, তোমার দুহাতের অঞ্জলিতে
                             মনে পড়ল নীলিমাময় শান্তিপ্রতিমা
আর আমার আনন্দ চতুর্দিকের হাওয়ায় হাওয়ায়
                             বাজিয়ে তুলছে নিবেদনের গান
(ঋণ)

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More