বাংলা অনুবাদে ‘টিনটিন’ এবং নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর হাতযশ

“ধেত্তেরি। সব ভাল যার শেষ ভাল। বুঝলেন?”

“নিশ্চয়...নিশ্চয়... তবে কিনা, তার চেয়েও ভাল কথা হচ্ছে সব ভাল যার শেষ ভাল।”

টিনটিনের কমিকসে ক্যাপ্টেন হ্যাডক আর প্রফেসর ক্যালকুলাসের কথোপকথন। কোনটা কে, নিশ্চয়ই আলাদা করে বলে দিতে হয় না। পাশে দাঁড়িয়ে টিনটিন (Tintin) আর তার কুকুর কুট্টুস মজা নিচ্ছে পুরো ঘটনার। সত্যি বলতে, পাতার পর পাতা জুড়ে এদের কর্মকাণ্ড বাঙালি পাঠককে ভরিয়ে দিয়েছে কৌতুকরসে। সেদিনের ‘আনন্দমেলা’ থেকে আজকের সামাজিক মাধ্যমে তৈরি হওয়া ‘মিম’—টিনটিনের জবাব নেই।

অ্যার্জের টিনটিন কমিকসের বেলজিয়ামে আবির্ভাব ঘটে ১৯২৯ সালে, ‘লে পেতিত ভিনগিতিয়েম’ ক্রোড়পত্রে। প্রথম গল্প ছিল ‘সোভিয়েতে টিনটিন’। বাংলায় তার আগমন ঘটতে কেটে যায় প্রায় পঞ্চাশ বছর। তার আগে পর্যন্ত বড়ো অংশের বাঙালি পাঠকের সঙ্গে টিনটিনের যোগাযোগ ছিল বলে মনে হয় না। তোপসের জবানিতে সত্যজিৎ রায় জানিয়েছিলেন, টুনটুনির বই নয়, টিনটিনের বই। ১৯৭৫-এ ‘আনন্দমেলা’-য় প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বোম্বেটে জাহাজ’ ও ‘লাল বোম্বেটের গুপ্তধন’। ওই সময়ই সম্পাদক রূপে যুক্ত হন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (Nirendranath Chakravarty)। তাঁর অনুবাদে লাল চুলের খুদে সাংবাদিক মন জয় করে নিল অচিরেই। 

আরও পড়ুন
টিনটিন, অ্যাস্টেরিক্সের ছবিতে সাজানো রাস্তা, কোথায় রয়েছে ‘কমিক বুক রুট’?

এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, টিনটিনের বিরুদ্ধে একাধিকবার উঠেছে ইহুদিবিদ্বেষ ও বর্ণবিদ্বেষের অভিযোগ। ‘সোভিয়েতে টিনটিন’ কমিউনিস্ট বিরোধী প্রোপাগান্ডায় ভরপুর। পরবর্তী কাহিনি ‘কঙ্গোয় টিনটিন’-এ বেলজিয়ামের উপনিবেশে টিনটিনের কাজকর্ম পরে লজ্জা দিয়েছে স্বয়ং অ্যার্জেকেও। আফ্রিকার দেশ সম্পর্কে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য ছত্রে ছত্রে ভরা এখানে। ফলে ‘আনন্দমেলা’-র মতো শিশু-কিশোরপাঠ্য পত্রিকায় বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হয়েছে অনুবাদককে। একই সঙ্গে যেহেতু ‘অনুবাদক মানেই বিশ্বাসঘাতক’, সেক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনকেও মাথায় রাখতে হয়েছে তাঁকে। ইংরেজি অনুবাদটিকেই যদি এক্ষেত্রে মূল বলে ধরে নেওয়া যায়, তাহলে বাঙালির বাকভঙ্গিমায় তফাৎ এসেছে বহুভাবে। কথা বেলুন কিংবা ক্যাপশনে অনেক ভারহীন-সংক্ষিপ্ত হয়েছে ভাষা। 

আরও পড়ুন
জর্জ, মিলু ও ‘কুট্টুস’ – টিনটিনের গল্পের আড়ালে লুকিয়ে যে আশ্চর্য প্রেমকাহিনি

কীরকম? উদাহরণ দেওয়া যাক ‘চাঁদে টিনটিন’-এর সেই বিখ্যাত ‘প্যানেল’-টি থেকে। চাঁদে নেমেছে টিনটিন। পৃথিবীর সঙ্গে স্থাপন করা গেছে যোগাযোগ। ইংরেজিতে সে বলছে, “That’s it!... I’ve walked a few steps!... For the first time in the history of mankind there is an EXPLORER ON THE MOON”। অথচ বাংলায়, “টিনটিন বলছি... মানুষের ইতিহাসে আমিই প্রথম চাঁদে পা রাখলাম।” ইংরেজি আবেগের আতিশয্য নেই এখানে। একেবারে বাহুল্যবর্জিত বক্তব্য। খানিক পরে লাফিয়ে লাফিয়ে আসবেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক। দূর থেকে পৃথিবীকে দেখে ইংরেজি অনুবাদে তাঁর মনে দেখা দিয়েছে আশা। আর বাংলায় নাটকীয় সংশয়, “ওখানে ফিরতে পারব তো?” কাহিনির মধ্যে যে এখনও অনেক জটিলতা বাকি আছে, তার সংকেত যেন ধরা এখানে। আবার, ‘তিব্বতে টিনটিন’-এ গুহার বাইরে ইয়েতি দেখার পর ক্যাপ্টেনের হুঁশিয়ারি, “TINT…BGLLB…TINTIN! LOOK OU-U-U-U-UT”। আর বাংলায় তা হয়ে যায়, “টিনটিন... বাবা গো!... টিনটিন! হুঁশিয়ার!” কমিকসের ভাষায় যাকে ‘Onomatopoeia’ বা ধ্বনিকৌশল বলে তার আশ্চর্য প্রয়োগ এখানে। ইয়েতির ‘GRHAWAARH’-কে অনুবাদে বাঙালির রাগ-ক্ষোভের অব্যক্ত ভাষায় লেখা হয় ‘গর্‌র্‌র্‌র্‌র্‌র্‌”। 

ক্যাপ্টেনের কথা যখন উঠলই, তখন স্বাভাবিকভাবে আসবে তার অপবাক্যের কথা। সেক্ষেত্রেও সচেতন থাকতে হয়েছে আনন্দমেলার সম্পাদককে। শুধু ‘কোটি কোটি জ্বালা ধরা ফোসকা’-র ক্ষেত্রে নয়, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে উদাহরণ। গোঁড়া ক্যাথলিক অ্যার্জের ভাষায় বহুবার এসেছে ধর্মীয় শব্দ, ইংরেজিতে প্রচলিত অপশব্দ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলি পরিণত হয়েছে পশুপাখি জাতীয় শব্দে। যেমন কালো ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত ‘স্লেভ ট্রেডার্স’ হয়ে যায় ‘ছারপোকা’। একইভাবে ‘কাঁকড়া রহস্য’-এর ‘সোয়াইন’ হয়ে যায় ‘উল্লুক’। যেহেতু ঘটনার প্রেক্ষাপট মধ্যপ্রাচ্য। সম্পূর্ণ রূপে বাদ দেওয়া হয় জনসন-রনসনের মসজিদ ভেঙে ঢুকে পড়ার দৃশ্য। কিংবা ধর্মীয় আচারে ব্যস্ত একজনকে লাথি মারার সম্পূর্ণ প্যানেলটি বাদ দিয়ে লেখা হয় “টিনটিন তো বেঁচে গেল, কিন্তু মানিকজোড় কোথায়? রহস্য! আরও রহস্য!” আনন্দমেলার পাঠকের উপর সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ যাতে, না জন্মায় তার আপ্রাণ চেষ্টা দেখা যায় এই বিষয়গুলিতে।

নাম বদলানোর ক্ষেত্রে জুড়ি নেই নীরেন্দ্রনাথের। সাদা রঙের মিষ্টি দেখতে ‘স্নোয়ি’ হয় কুট্টুস। বার্ডদের ‘ব্রুটাস’ যেন চিরপরিচিত বাঙালি কুকুর ‘বাঘা’। থম্পসন ও থমসন-এর কঠিন উচ্চারণ হয়ে যায় জনসন-রনসন। কে ভুলতে পারে বিয়াঙ্কা ক্যাস্তোফিওর-এর বারবার হ্যাডককে নতুন নামে ডাকার মজা? তার সঙ্গে রইল কোকিলকণ্ঠে বিখ্যাত সব গান, “তোমার রূপের তুলনা কোথায়? সুন্দরী লো...” আর অবশ্যই প্রফেসর ক্যালকুলাস। দুর্বল শ্রবণশক্তির এই অধ্যাপক প্রতিটা কথার আশ্চর্য পুনরাবৃত্তির উদাহরণ দিতে গেলে শেষ হয়ে যাবে পাতার পর পাতা।

আসলে টিনটিনের চরিত্ররা বিদেশি হয়েও প্রবলভাবে দেশীয়। মূলত তার অনুবাদের গুণেই। বাংলা তথা ভারতের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ঔপনিবেশিকতার দায়ভার থেকে মুক্তি পেয়েছে বলেই তারা এতটা আপন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছাড়াও আরো অনেকের সম্পাদনাতেই প্রকাশিত হয়েছে ‘টিনটিন’। যেহেতু অনুবাদকের নাম লেখা থাকত না, ফলে পরের দিকে কার অনুবাদে সেগুলি প্রকাশিত হয়েছে তা গবেষণাসাপেক্ষ। পরিষ্কার বোঝা যায়, অনুবাদশৈলীর পার্থক্য। তবুও টিনটিন বাঙালির ঘরের ছেলে। আমেরিকা বা তিব্বত যেখানেই ঘুরে বেড়াক না কেন, হাওড়া ব্রিজের তলায় ধুতি-পাঞ্জাবি পরা টিনটিনও মানিয়ে যায় অনায়াসে। 

ঋণস্বীকার : কমিকস ইতিবৃত্ত, কৌশিক মজুমদার
টিনটিন চিত্রকাহিনির বাংলা অনুবাদ : একটি সাংস্কৃতিক পাঠপ্রয়াস, পিনাকী মাইতি

Powered by Froala Editor

More From Author See More