‘‘বেঁচে থাকো, যে আছ যেখান
বেঁচে
থাকো।
যেমন
করেই হোক,
মরতে-মরতে
জোড়া-পায়ে মৃত্যুর পাঁজরে লাথি মেরে
বেঁচে
থাকাটাই বড় কথা।’’
আবারও চলে এল আরও একটা ২৫ ডিসেম্বর। যীশু আরেকটু বৃদ্ধ হলেন। আগের বছরও কলকাতায় এমনভাবেই এসেছিল বড়দিন। শীত, রোদ, আর আলোর পাশাপাশি একটু যেন আর্দ্রও হয়ে উঠেছিল তিলোত্তমা। ভেজা চোখে ভিড় বাড়িয়েছিল কলকাতার যীশু’রা। ২০১৮-এর রাক্ষুসে শীত কেড়ে নিয়েছিল আরও এক আশ্রয়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীর লগ্নে আরও একবার স্মৃতি সেঁকে নেওয়া…
‘রাজা, তোর কাপড় কোথায়?’— স্পষ্ট ভাষায় এমন প্রশ্ন করার স্পর্ধা আজও দিয়ে যাচ্ছেন যে মানুষটি, তাঁর জীবনটাও কম আকর্ষণীয় ছিল না। একাধারে কবি, গদ্যকার, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক, সাংবাদিক— লিস্ট অনেক লম্বা। নীরেন্দ্রনাথ, বলা ভাল ‘নীরেন দা’র সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, সবারই কিছু না কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে। এখন তো, সেই স্মৃতিগুলোকেই উস্কে নেওয়া।
পুব বাংলায় জন্মেছিলেন তিনি। সেখানকার প্রকৃতির স্পর্শেই কেটেছে শৈশব। নিজের ভেতর সবসময় নিয়ে চলতেন সেই মাঠ, ক্ষেত, রেল স্টেশন। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখতেন। সেই নিয়েই একদিন কলকাতায় পা। ১৯৫৪। সিগনেট থেকে বের হল প্রথম কবিতার বই ‘নীলনির্জন’। তারপর কত বই, কত সম্মান পেয়েছেন তিনি। সে-বৃত্তান্ত এখন থাক। কবিতা, গল্প, সবেতেই যে তাঁর প্রধান নায়ক ছিল মানুষ, সে কথা বারবার দ্ব্যর্থহীন হয়ে বলেছেন তিনি।
আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন তিনি। ছিলেন আনন্দমেলার সঙ্গে। সেখানেই পথ চলা শুরু সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। সেখানেও তিনি নিজেকে চিনিয়েছিলেন। সতীর্থ ও সহকর্মীদের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে এরকম কত গল্প। একটা সময় থেকে আনন্দমেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল কাকাবাবু। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে সেই অ্যাডভেঞ্চারে নেমে পড়তে যেন ওঁত পেতে থাকত শিশুরা। একবার হয়ে গেল বিপত্তি। কাকাবাবুর গল্প ছাপা হয়েছে ঠিকঠাক, কিন্তু ছবিতে থেকে গেছে গণ্ডগোল। কাকাবাবুর গোঁফটাই যে হাপিস! বাচ্চাদের চিঠি জমতে লাগল দফতরে। হইহই পড়ে গেল, যেন এটাও একটা রহস্য। এই সাংঘাতিক ভুল সামলে নিলেন সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ। সেই সব অভিযোগপত্রের চিঠি ছাপলেন। সঙ্গে ছাপতে দিলেন আরও একটা জিনিস। শিল্পীর আঁকা দুটো গোঁফ। নীচে লেখা, কাকাবাবুর হারিয়ে যাওয়া গোঁফ। ব্যস! ছোটরাও খুশি, এদিকে বড় বিপদ থেকেও রক্ষা পেল আনন্দমেলা।
‘কবিতার ক্লাস’ নেওয়া মাস্টারমশাই নীরেন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হলেও, ওঁর আরেকটা কাজ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছিল কেন, আজও আছে। ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’। আনন্দবাজারের বানানবিধি, কাগজের প্রুফ দেখা, লেখার ধরন— সমস্ত কিছুকেই দুই মলাটে রেখেছিলেন তিনি। আজও, তরুণ সাংবাদিকদের কাছে এই বইটি সর্বক্ষণের সঙ্গী।
আরও পড়ুন
সংসারে অর্থকষ্ট, জন্মদিনে মেয়েকে কবিতা উপহার দিলেন বুদ্ধদেব বসু
একে একে তাঁর সামনেই চলে যাচ্ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়রা। একসময়ের স্নেহভাজন এই কনিষ্ঠদের মৃত্যু কখনই মেনে নিতে পারেননি তিনি। বারংবার শোনা যেত সেই খেদ। ঘনিষ্ঠ বন্ধু রমাপদ চৌধুরীর মৃত্যু যেন ডাক দিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। ডাকে সাড়া দিতে দেরি করেননি নীরেন্দ্রনাথ। আর কোনদিন সাড়া দিলেন? ২৫ ডিসেম্বর, কলকাতার যীশুর দিনে। সৃষ্টির কাছেই অবশেষে ফিরে গেলেন স্রষ্টা। মাঝখানে কেটে গেল একটি গোটা বছর। রয়ে গেছে স্মৃতি, সৃষ্টি। শীতের শহর আরও একবার উস্কে নেবে সেসব।
(ঋণ - আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৮)
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা