নিমগাছ নয়, বরং নিয়ামৎতুল্লাহ মসজিদের নামেই নামকরণ ‘পুণ্যক্ষেত্র’ নিমতলার?

কলকাতার পুরনো অঞ্চলগুলির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে অজান্তেই ছায়া পড়ে ইতিহাসের। সেখানে কত নাম, কত কাহিনি। কে জানে, তার কোনটা ঠিক! কত কাহিনির পাতা হলুদ হয়ে জমে আছে কোনো গোপন কোণে। সেখানে কখনও কি রোদ পড়ে না? এসব কথা ভাবতে ভাবতেই আমাদের গাড়ি এসে পৌঁছল নিমতলা অঞ্চলে। উত্তর কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যশালী একটি অঞ্চল; যার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে জানা অজানা আখ্যান।

হুগলি নদীর পশ্চিম তীরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি শ্মশান। শুধু শ্মশান নয়, মহাশ্মশান। এবং সে-কারণে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর কাছে নিমতলা পুণ্যক্ষেত্রও বটে। এই শ্মশানেই বিলীন হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নশ্বর দেহ। তালিকাটি বেশ দীর্ঘই। খ্যাত-অখ্যাত মানুষের শেষ মুহূর্তের আয়না এই শ্মশান ও তৎসংলগ্ন ঘাট। কথায় বলে, নামকরণের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের একটা চিহ্ন। তাকে খুঁজে বের করাই ঐতিহাসিক ও গবেষকদের কাজ। হয়তো নতুন কোনো পরত খুলে আসে! সেই একই পথ ধরে এসে পড়ে নিমতলার নাম-মাহাত্ম্য।

নানা কিংবদন্তি রয়েছে এই নাম ঘিরে। বলা হয়, শ্মশানঘাটের ধারের এক বিশাল নিমগাছ থেকেই নাকি এই অঞ্চলের নামকরণ। অনেক বইতেও এই কাহিনিটির উল্লেখ আছে। কোথায় সেই গাছ? সে কি এখনও শ্বাস নিচ্ছে? দেখে নিচ্ছে তার পুরনো আত্মাকে? জানা যায় না। বরং চোখ ফেরানো যেতে পারে দুটি স্থাপত্যের দিকে। দুটোই ধর্মস্থান। শ্মশানের আগে চলে গেছে চক্ররেলের লাইন। তার আগেই নিমতলার বিখ্যাত আনন্দময়ী কালী মন্দির। লাল রঙের মন্দিরটির ভেতরের বিগ্রহটি আদতে শ্মশানকালী। শ্মশান থেকে দূরে কালীর মন্দির? শুনতে খানিক অবাকই লাগে।

আসলে এর পেছনে রয়েছেন স্বয়ং মা গঙ্গা। আজ তার যে অবস্থান, যে পরিসর; ৩০০ বছর আগে সেই পরিসর ছিল না। নদী আরও চওড়া ছিল। আজ যেখানে আনন্দময়ী কালী মন্দির, তার ঠিক পাশ দিয়েই একসময় বইত গঙ্গা। আজকের স্ট্র্যান্ড রোডের অস্তিত্বই তখন ছিল না। আর সেইজন্য নিমতলা শ্মশানও বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করে। ইংরেজ আমলের কিছু বই অনুযায়ী, জোব চার্নকের জাহাজ নিমতলা শ্মশানের কাছের এই নিমগাছেই নোঙর ফেলে। পরে নাকি গাছটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। নিমগাছে নোঙর ফেলা হয়েছিল বলেই কি নিমতলা?

একটু আগেই বলছিলাম দুটো ধর্মস্থানের কথা। একটির কথা তো বলা হল। দ্বিতীয়টির সঙ্গেও জুড়ে আছে নিমতলার নাম-মাহাত্ম্য। আনন্দময়ী কালী মন্দিরের আগেই আপনার নজর টানবে একটি মসজিদ। নাম নিয়ামৎতুল্লাহ মসজিদ। ১৭৮৪ সালে এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন মহম্মদ রমজান আলি। নিজের পূর্বপুরুষের নামে এখানেই এই মসজিদটি তৈরি করেন। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা মিথ। স্থানীয়রা বলেন, মসজিদের তলায় নাকি গোপন সুড়ঙ্গ গঙ্গার ঘাট অবধি চলে গেছে। নিয়ামৎতুল্লাহ আর নিমতলা— অনেকটা অপভ্রংশ হয়ে আসা শব্দ মনে হচ্ছে না? তাহলে কি নামকরণের পেছনে রয়েছে এই মসজিদটি? প্রশ্ন আসে…

অবশ্য সম্প্রীতির নানা উদাহরণ তৈরি করেছে এই বিশেষ মসজিদটি। এখানকার সমস্ত ধর্মের সব মানুষের কাছে ‘আমাদের’ মন্দির, ‘আমাদের’ মসজিদ। আমরা-ওরা বিভেদে না গিয়ে তৈরি হয়েছে এক অদ্ভুত মিনার। অবশ্য এই প্রথা চলে আসছে মহম্মদ রমজান আলির সময় থেকেই। একটা সময় ঘাটে নাকি হিন্দু মুসলিম একসঙ্গে স্নান করতেন। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ বড়ো সুখস্মৃতি।

আরও পড়ুন
প্রয়াত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের প্রপৌত্র, রাজপরিবারের শেষ বংশধরকে হারাল কলকাতা

নিমগাছ না নিয়ামৎতুল্লাহ? বিতর্ক থেকেই যাবে। দেখতে দেখতে বিকেলের ছায়া পড়বে ঘাটে। অস্থি ভাসিয়ে কেউ উঠে আসবেন ভেজা কাপড়ে। তখনই হয়ত বেজে উঠবে আজান ধ্বনি; কিংবা মন্দির থেকে ভেসে আসবে ধূপের গন্ধ। কলকাতার বুকেও যেন আলো পড়ল একটু। পরক্ষণেই লুকিয়ে ঢুকে গেল গর্তে। তাকে ধরার জন্যই তো এত অভিযান!

তথ্যঋণ – কলিকাতার পথে পথে / সন্দীপ চক্রবর্তী

নিম গাছ ~ নিমতলা ~ নিয়ামৎতুল্লাহ্‌, কলকাতার ‘সাত’কাহন

আরও পড়ুন
নিমতলায় পৌঁছোতেই পারেননি কবিপুত্র, রবীন্দ্রনাথের মুখাগ্নি করলেন কে?

Powered by Froala Editor

More From Author See More