দশমীর দিন। সবারই কমবেশি মনখারাপ। এতদিনের আয়োজন, উৎসব এবার শেষ। মা বিদায় নেবেন। আবারও অপেক্ষা একবছরের। ঢাকের বোলেও স্পষ্ট শোনা যায় ‘আসছে বছর আবার হবে’। ‘বাড়ির মেয়ে’ শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে; যেমন তেমনভাবে পাঠালে হয় নাকি? সেই প্রাচীন সময় থেকেই বঙ্গদেশ দেখে আসছে বিজয়ার লোকাচার। বারোয়ারি পুজোর বাইরে, ঐতিহ্যশালী ও বনেদি পুজোগুলোর দিকেই বেশি নজর থাকে এইদিন। এক একটি বাড়ির এক একরকম আচার। তবে সেইসবের সঙ্গেই জুড়ে থাকে আরও একটি বিশেষ নিয়ম। হাজির হয় নীলকণ্ঠ পাখি। দশমীর দিন এই পাখি না থাকলে বাংলার আসল উপাচারই যে করা হবে না!
সেই রামায়ণের কাহিনি থেকেই নীলকণ্ঠ পাখি পুজোর আঙিনায় নিজের জায়গা তৈরি করে রেখেছে। মনে করা হয়, রাবণবধের ঠিক আগে এই পাখিটির দেখা পান রামচন্দ্র। তার আগেই যে তিনি সম্পন্ন করেছেন অকাল বোধন! আবার এক অংশের মতে, রাবণবধের আগেও, সেতুবন্ধনের সময় হাজির হয়েছিল নীলকণ্ঠ পাখি। পথ দেখিয়ে রাম-বাহিনীকে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিল সে। এরকম পৌরাণিক কাহিনি থেকেই এই পাখির মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। তখন থেকেই প্রচারিত হয়, এই পাখির দর্শন অত্যন্ত শুভ…
প্রাণীবিজ্ঞানের খাতা খুললে, এর পরিচয় পাওয়া যাবে ‘ইন্ডিয়ান রোলার’ হিসেবে। বাংলা নামটি কিন্তু বেশ। অন্তত, চেহারার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মানানসই। অবশ্য নীলকণ্ঠ বললে আবারও ফিরে যেতে হবে পুরাণে। সমুদ্রমন্থনের সময় বিষ উঠে এলে দেবতা ও অসুরদের রক্ষা করতে চলে আসেন দেবাদিদেব মহাদেব। সেই তীব্র বিষ নিজেই পান করেন; আর বিষের জ্বালায় তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে যায়। সেখান থেকেই তাঁর আরেক নাম ‘নীলকণ্ঠ’। এই পাখিটিকে দেখলেও অনেকটা সেই কথাই মনে পড়বে। শরীর জুড়ে যেন নীলের খেলা। আর সেখান থেকেই উঠে আসে নীলকণ্ঠ…
ঠিক কবে থেকে বাংলার দুর্গাপূজার ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেল নীলকণ্ঠ পাখি, জানা যায় না। তবে বনেদি বাড়িগুলোয় প্রাচীন সময় থেকেই যে জুড়ে আছে এই পাখি, তা বলাই যায়। মনে করা হয়, নীল কণ্ঠের জন্য এই পাখি স্বয়ং শিবেরই এক সঙ্গী। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে উমা। সেই খবর আগে জানাতে হবে না ভোলানাথকে? সেই খবরই নিজের ডানায় নিয়ে পাড়ি দেয় নীলকণ্ঠ পাখি। সে চলে গেলে, তারপর বিসর্জনের উদ্দেশ্যে বের হয় প্রতিমা।
বহু বছর ধরে বনেদি বাড়িগুলোয় এই প্রথা চলে আসছে। তবে এখন সেই রীতির ওপর পড়েছে নিষেধের বেড়াজাল। নীলকণ্ঠ পাখির দর্শন শুভ— সেজন্য বেশ কিছু জায়গায় খাঁচায় বন্দি করে রীতিমতো ব্যবসাও শুরু করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে ছিল চোরাশিকারির উৎপাত। তিন তিনটি রাজ্যের ‘স্টেট বার্ড’ বা রাজ্য পাখি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে নীলকণ্ঠ। তবুও অবৈধ কারবারিদের নজর লেগেই আছে। এছাড়াও, খাঁচায় দিনের পর দিন বন্দি থাকতে থাকতে অনেকসময় আহতও হয়ে যেত। ফলে অনেক পাখি মারাও পড়ত। সেইহেতু, এখন নীলকণ্ঠ পাখি ধরা, বা খাঁচায় আটকে রাখা আইনত নিষিদ্ধ।
কিন্তু লোকাচার কি এত সহজে শেষ হয়? বিজয়া দশমীর সঙ্গে যে নীলকণ্ঠ পাখি রন্ধ্রে রন্ধ্রে জুড়ে গেছে। হাতে গোনা কয়েকটা বনেদি বাড়ি ছাড়া জ্যান্ত নীলকণ্ঠ পাখি রাখা হয় না। তার বদলে তৈরি করা হয় পাখিটির মাটির মূর্তি। সে-ই নিয়ে যাবে উমার বাড়ি ফেরার সংবাদ। তারপর, একটি বছরের অপেক্ষা। আসছে বছর আবার তো হবে…
আরও পড়ুন
অভাব ও অন্ধকারের কবলে বাটানগরের পুজো; নবমীর সন্ধ্যাতেও বিষাদের সুর?
Powered by Froala Editor