স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা অলিম্পিয়ান, বিস্মৃতির অতলে নীলিমা ঘোষ

কথায় বলে, ‘ধন্যি মেয়ে’। তবে এই কথার কথাকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন খুব কমজনই। যদি স্বাধীনতার মাত্র ৫ বছরের মধ্যে নারীসমাজের মধ্যে থেকেই কেউ ছিটকে আসেন অলিম্পিকের স্প্রিন্টে? যদি কেউ সমাজের চোখে যা অবিশ্বাস্য, তাকেই বাস্তব করে দেখান? যদি ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসে প্রথম মহিলা হিসেবে অলিম্পিক ট্র্যাক ইভেন্টে পা পড়ে কোনো বাঙালি মেয়ের? তবে তাঁর পদাঙ্কে যে ধন্য হয় উত্তরপ্রজন্ম, তা হয়তো বলার অবকাশ রাখে না। এমনই ধন্যি মেয়ের নাম নীলিমা ঘোষ। দেশের মহিলা ট্র্যাক ইভেন্টে অংশ নেওয়া প্রথম অলিম্পিয়ান, ১৯৫২ হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে যিনি পা রেখেছিলেন ট্র্যাকে।

স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে লন্ডনে বসল অলিম্পিকের আসর। অনেকের কাছেই আজ হারিয়ে যাওয়া নাম হেনরি রেবেলো। কিন্তু এই ১৯ বছরের তরুণই ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে এই দেশের প্রথম অলিম্পিয়ান। লন্ডন অলিম্পিকে নিজের প্রিয় ট্রিপল জাম্প ছাড়াও রেবেলো অংশ নেন লং এবং হাই জাম্পেও। না, পদক আসেনি। তবু ২০১৩-তে স্বাধীন দেশের প্রথম অলিম্পিয়ানের মৃত্যুর পর কতটুকুই বা মনে রেখেছিলাম তাঁকে?

তবে রেবেলোর চেয়েও হয়তো আরও কয়েকশো গুণ কঠিন কাজ করে দেখিয়েছিলেন নীলিমা ঘোষ। ১৯৪৮ লন্ডনের পর ১৯৫২ সালে ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে বসল সামার অলিম্পিকের আসর। বিখ্যাত হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে দেশের প্রথম মহিলা হিসেবে ট্র্যাক ইভেন্টে অংশ নেবার সুযোগ পেলেন বাঙালি মেয়ে নীলিমা। ১৯৩৫ সালের ১৫ জুন জন্ম নীলিমার। সে সময়ে বাংলার অলিতে গলিতে শুধুই ফুটবল। চল্লিশের দশকেও সমাজের গোঁড়া মানসিকতার কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ক্রীড়াক্ষেত্রে মেয়েদের আগমন ছিল বিরল। সার্কাস, জিমন্যাস্টিকে মহিলাদের প্রদর্শনের জায়গা থাকলেও খেলার মূলস্রোতে মেয়েদের আসাটা শুরু হয়নি সেভাবে। 

এর মাঝেই দেশভাগের অন্ধকার। সামাজিক পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত যে মেয়েদের ঘর থেকে বেরোনোই ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ল। কিন্তু নীলিমার উত্থানটা বড়োই অদ্ভুত, তার চেয়েও বেশি আকস্মিক। ১৯৫২ হেলসিঙ্কি অলিম্পিকের পরে আর কোনো মেজর বা মাইনর ইভেন্টে অংশ নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায় না তাঁর সম্পর্কে। হেলসিঙ্কিতে যখন নীলিমা ডাক পেলেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭। একই সঙ্গে আরও এক ভারতীয় মহিলার পা পড়েছিল ট্র্যাকে ঐ অলিম্পিকেই, তিনি মেরি ডিসুজা। তবে মেরি ডিসুজা তখন ক্রীড়ামহলে কিঞ্চিৎ পরিচিত নাম, ১৯৫১ এশিয়াডে ব্রোঞ্জ জয়ের সুবাদে। 

শোনা যায়, ভারত সরকার প্রাথমিকভাবে হেলসিঙ্কিতে পাঠাতে চাননি মেরি ও নীলিমাকে। সে সময়ে ফিনল্যান্ড যাত্রার অত্যধিক খরচ বহনের ভার নিতে চায়নি সরকার। তাই শেষ অব্দি ডিসুজার বন্ধুদের উদ্যোগেই জোগাড় হয় ফান্ড।

নীলিমা অংশ নিয়েছিলেন দুটি ইভেন্টে। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট ও ৮০ মিটার হার্ডল। ১০০ মিটারের প্রথম রাউন্ডের প্রথম হিটেই ট্র্যাকে পা রাখেন নীলিমা। প্রথম স্বাধীন ভারতীয় মহিলা হিসেবে। এই তৃতীয় স্থানাধিকারিণী আর্জেন্টিনার লিলিয়ান হেইনজের থেকে ০.১ সেকেন্ড পরে শেষ করলেন তিনি। ১৩.৬ সেকেন্ড। আর ৮০ মিটার হার্ডলে তিনি শেষ করলেন হিটের বিজয়িনীর চেয়ে ২ সেকেন্ড পরে। ফলতঃ পদকের থেকে অনেকটাই হয়তো দূরে শেষ করলেন তিনি, কিন্তু স্বাধীনতার ৫ বছরের মধ্যে নীলিমার অলিম্পিকে অংশগ্রহণ ভেঙে দিল অনেক মিথ। ডিসুজার হিট নম্বর ছিল ৯, নীলিমার পিছনে, তাই একই অলিম্পিকে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও প্রথম মহিলা অলিম্পিয়ান নীলিমাই। 

আরও পড়ুন
এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রথম স্বর্ণপদকজয়ী শচীন নাগ, পরবর্তীতে ডাক পাননি দেশের আয়োজনেই

১৯৫২ সালের পর অলিম্পিকের ইতিহাসে অনেক মহিলা ক্রীড়াবিদ এসেছেন। প্রায় ৭০ বছরে ৮৪-এর পিটি ঊষা থেকে ২০০৪-এর চিত্রা সোমান, ঐ বছরই অঞ্জু ববি জর্জ থেকে হালফিলের ললিতা বাবর- অলিম্পিক ট্র্যাকে একের পর এক ভারতীয় নারীর গৌরবগাঁথা লেখার স্থপতি কিন্তু সেই এক বাঙালিই, নীলিমা ঘোষ...

Powered by Froala Editor