“বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নোবেল বিজয়ীরা বেশ খানিকটা প্রবীণ অথবা প্রৌঢ়। ফলে তাঁদের মুখের আদলের রেফারেন্স পেতে আমার কাছে যা আসে, তা কয়েক দশক আগের কোনো ছবি। হয়তো কোনো ক্লাস নিচ্ছেন তিনি, সেই সময়ের। কিংবা নিছকই গবেষণার কাজে মগ্ন হয়ে আছেন, এমন কোনো মুহূর্তের তোলা ছবি। আমি আমার একশো শতাংশ দিয়েই চেষ্টা করি ছবিটা আঁকার। তবে কতটা তাঁর রূপদান হয়, তা অন্যেরা বলুক।”
বলছিলেন নিকলাস এলমেহেদ। তিনি ‘কিংবদন্তি’ কিনা বলা শক্ত। কিন্তু কিংবদন্তিদের রূপকার তিনি, এ-কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। তাঁর আঁকা ছবি অক্টোবর থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক মাসে লক্ষ লক্ষ লাইক, শেয়ার কুড়োয়। কিন্তু তিনি? না, কোনো সংবাদ মাধ্যমের পাতায় নেই! সোশ্যাল মিডিয়াতেও ‘ভাইরাল’ নন তিনি। সব মিলিয়ে টেনেটুনে হাজার দুয়েক ফলোয়ার তাঁর। নোবেল কমিটির হেড কোয়ার্টার যে শহরে, সেই সুইডেনের স্টকহোমই ঠিকানা নিকলাসের। তবে নোবেলের সমারোহ শেষ হলে স্টকহোমে অক্টোবরের হালকা কুয়াশার মধ্যেই মিশে যান তিনি। মেতে থাকেন নতুন সৃষ্টির ছন্দে। প্রচারবিমুখ হয়েই।
“২০১৪ সালে বিবিসি যোগাযোগ করেছিল আমার সঙ্গে। ওরা খবর করেছিল আমায় নিয়ে।” শিশুসুলভ হাসি খেলে উঠল নিকলাস এলমেহেদের গলায়। না, তারপর আর কেউই খোঁজ রাখেনি তাঁর। সমস্ত ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম নোবেলজয়ীদের ছবির নিচে ‘ইলাসট্রেটর’ হিসাবে তাঁর নাম লিখেই দায় সেরেছে। সারছে এখনও। প্রতিটা প্রিন্ট মিডিয়া থেকে শুরু করেই ডিজিটাল অবধিই এই ট্রেন্ড। সত্যিই তো যে ছবিতে কপিরাইট নেই শিল্পীর, তাঁর খোঁজ রাখার প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু?
সপ্তাহ জুড়ে চলছে নোবেল বিজয়ী ঘোষণার মহড়া। ফলে তাঁর ব্যস্ততা থাকতে বাধ্য। কিন্তু প্রহরের আহ্বান ফেরাননি নিকলাস। সময় দিলেন প্রত্যাশিতের চেয়ে বেশিই। আর ভারতের সীমানা পেরিয়ে সেলফোন টাওয়ার ধরিয়ে দিল সুইডেনের ফোন নম্বরকে। শুরু হল কথা। ইংরাজিতেই চলছিল কথোপকথন।
নিশ্চয়ই নোবেল ঘোষণার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বিজয়ীদের নাম জেনে যান নিকলাস? কিন্তু কতটা আগে থেকে? প্রশ্ন শুনে হাসলেন তিনি। “আমি নোবেল বিজয়ীদের পোর্ট্রেট আঁকি, এটা জানলেই সবাই প্রথমে এই প্রশ্নটাই করে। সকলেই। কিন্তু সেটা আমি একেবারেই বলতে পারব না। এটা কনফিডেন্সিয়াল। কিন্তু খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না।”
আরও পড়ুন
মৃত্যুর মুখে আশ্রয় পেয়েছিলেন কবিতায়, নোবেলে যেন সেই ঋণই শোধ করলেন লুইস গ্লুক
সে না হয় না-ই জানা গেল। কিন্তু কতটা সময় লাগে এই ছবি আঁকতে? “সব মিলিয়ে দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয় রং-তুলির কাজ। কখনো হাত চালাতে হয় তার থেকেও দ্রুত গতিতে।”, জানালেন নিকলাস। ভাবতেও শিহরণ জাগে মাত্র দু’-তিন ঘণ্টায় আঁকা এই ছবিগুলোর পরিপূর্ণতা, নিপুণতা দেখেই।
পেশাদার চিত্রশিল্পী হিসাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ২০০৯ সালে। কথায় কথায় জানা গেল, ২০১৪ সাল থেকেই একটানা নোবেল বিজয়ীদের ছবি এঁকে চলেছেন তিনি। গত বছর এঁকেছেন ১৫টি পোর্ট্রেট। অবশ্য নোবেল কমিটির সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়া তারও আগে। নোবেল কমিশনের শৈল্পিক পরিচালক হিসাবেই অভিষেক হয়েছিল তাঁর ২০১২ সালে। নোবেল কমিটির সমস্ত স্কেচ এবং সামাজিক মাধ্যমের শৈলী তখন থেকেই প্রকাশ্যে আসত তাঁর হাত ধরে। তবে ২০১৪ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সার হিসাবেই কাজ করছেন নিকলাস।
আরও পড়ুন
যেতে হয়নি সুইডেনে, রবীন্দ্রনাথের জন্য কলকাতাতেই হাজির হয়েছিল নোবেল পদক
কিন্তু এই কাজের জন্য নোবেল কমিশনের কত বছরের চুক্তি রয়েছে তাঁর সঙ্গে? “২০১৪ সালের পর থেকে এই কাজের জন্য প্রতিবছরেই ডাক এসেছে আমার। কিন্তু না, কোনো চুক্তি নেই আমাদের মধ্যে। পরের বছর এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের ছবি আঁকার সুযোগ আসবে কিনা তাও জানা নেই। তার জন্য পরের বছর পর্যন্তই অপেক্ষা করতে হবে”, নিজের স্বভাবসিদ্ধ সহজ ভঙ্গিতেই বললেন নিকলাস।
একজন শিল্পীর উপার্জনের পথই হল তাঁর শিল্প। কিন্তু আর্থিক দিকটা বাদ দিলে এই কাজ তাঁর কেমন লাগে? “আমার এক মুহূর্তও ক্লান্তি লাগেনি কোনোদিন। এতটুকুও না। সময়ের ডেডলাইন, চাপ তো থাকেই। কিন্তু বিরক্তি লাগে না আমার এই কাজটা করতে। আসলে যাঁদের ছবি আমি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছি ক্যানভাসে তাঁরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু মানুষ। গবেষণা বা কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন নতুন আবিষ্কারের জন্য। এই পুরস্কার যেমন তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্য। তেমনই ন্যায্য প্রাপ্য এই পোর্ট্রেটও। পৃথিবীর সেরা মস্তিষ্কদের জন্য এইটুকু তো করাই যায়।”
আরও পড়ুন
দুঃস্বপ্নে হানা হিটলারের, যৌথ গবেষণায় ভাঙন; নোবেলই মিলিয়ে দিল দুই বিজ্ঞানীকে
এই উত্তরের পর আর সত্যিই কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে কি? নিকলাস যেন মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, একজন শিল্পীর পরিপূর্ণতা শুধু শিল্পে নয়। তাঁর মানসিকতাতেও। সেখানেই অন্যদের থেকে অনেক অনেক আলাদা তিনি। তবে বিস্ময়ের পালা শেষ হয়নি তখনও। পরের প্রশ্নটা এল ফোনের ওপার থেকে। প্রচণ্ড আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাষায় প্রকাশিত হবে এই প্রতিবেদন? ‘বেঙ্গলি’ শুনে শিশুর মতো হাসি। “ও হ্যাঁ। আমি জানি। বাংলা।” শুনে থমকে যেতে হয়। ‘বেঙ্গলি’র বাইরেও ‘বাংলা’ বলেই চেনেন নিকলাস? উচ্চারণটা শোনার পরেও বিশ্বাস হচ্ছে না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, গত বছর নোবেলজয়ী বঙ্গসন্তান অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিও তো এঁকেছেন তিনিই। অন্যদিকে তখন একটানা কথা বলে যাচ্ছেন নিকলাস, “কিন্তু খুবই দুঃখের বিষয় আমি তো বাংলা ভাষা জানি না। পড়তে পারি না। তবে গুগল ট্রান্সলেটার মাধ্যমে পড়ব অবশ্যই।” এই সরলতার সামনে আর কীই বা বলার!
গত বছর নোবেল বিজয়ীদের ছবি টাঙানো এক দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে নিকলাস ছবি পোস্ট করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ক্যাপশন ছিল ‘গোল্ডেন ওয়াল’। তবে কি সোনা দিয়েই আঁকা পোর্ট্রেটের সোনালি শেডগুলো? সেই রহস্যেরও সমাধান করলেন স্বয়ং শিল্পীই। “না, সোনা নয়। তবে এক ধরণের মেটাল ফয়েল দিয়েই ওই সোনালি রঙের প্রলেপ। তবে প্রথমদিকে এর ব্যবহার হত না। তখন কালো, হলুদ আর নীল রঙের মাধ্যমেই আঁকা হত লরিয়েটদের ছবি। তারপর থেকে এই ধাতুর পাতের মাধ্যমেই ওই রং করা হয়।”
গোল্ড ফয়েল দিয়ে আঁকা না হলেও, ওই দেয়াল যে গোল্ডেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। প্রতিটি পোর্ট্রেটের পিছনে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রের এক একজন নক্ষত্র। যাঁদের আলোয় খুলে যাচ্ছে গবেষণার নতুন দিগন্ত, একুশ শতকের অসহিষ্ণু কঠিন সময়েও ঘনিয়ে আসছে শান্তির মেঘ, কিংবা অপার্থিব সাহিত্যের মায়াজাল। তবে এই সব নক্ষত্রের আলোর মধ্যেই যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আরও এক নক্ষত্রের উপস্থিতি। কিংবা আমরাই হয়তো খুঁজে দেখতে চাইছি না তাঁকে, তাঁর শিল্পকে। যার সামনে বিস্ময় নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই নক্ষত্রের নামই নিকলাস এলমেহেদ...
Powered by Froala Editor